ফিচার্ড লেখালেখি

রম্য লেখা ||| ছগির উদ্দিন

রম্য লেখা ||| ছগির উদ্দিন

কৈশোরে পরিচিত হয়েছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলী, শরৎচন্দ্র, বিমল মিত্র, আশুতোষ ও শংকরসহ অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাসের সাথে। রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য ও কবিতা বুঝতাম না তাই সে বয়সে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। শুধু মাত্র তাঁদের গান আমাকে মুগ্ধ করতো। না বুঝেও কেন মুগ্ধ হতাম সে কথা এখনো বুঝতে পারি না। সে যা হোক, কৈশোরে অনেক গল্প উপন্যাসে পড়েছিলাম “বাবু সদ্য বিলেত ফেরত”। আহ ! কি চমৎকার। সে বয়সে বিলেত ফেরত হতে চাওয়া অমূলক নয়। কিছু কিছু ইচ্ছে, অজানা কারণে কিশোর মনে দাগ কেটে যায়। বিলেত ফেরত হওয়া তেমনই একটি আকাঙ্খা নিজের অজান্তেই সৃষ্টি হয়েছিলো। কৈশোরে বিলেত ফেরত না হলেও তারুণ্যে সদ্য জাপান ফেরত হয়ে বেঙ্গল ফাইন সেরামিক্সে মান নিয়ন্ত্রণ প্রধান পদে আসীন হয়েছিলাম। জাপান ফেরত হওয়াতে নিজের মনে এক ধরণের তৃপ্তি ও সুখ অনুভব করতাম। অনেকটা পাগলের সুখ মনে মনে। সুখের আরেকটা কারণ বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্স কারখানাটি সাভারে অবস্থিত ছিল, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে এ এলাকায় অনেক বার এসেছি। কিছু কিছু স্থানীয় লোকদের সাথে সে সুবাদে আগে থেকেই আলাপচারিতা ছিল। তাছাড়া আমার সহপাঠীদের অনেকেই এ এলাকায় বসবাস করতো। দু’জন সহপাঠী রায়হান আর নন্দিতা ব্যানার্জি সে সময় সাভার কলেজে অধ্যাপনাও করতো।

জাপানে যাবার আগে এ কারখানায় সপ্তাহ খানেক এসেছিলাম, তখন কেবল মাত্র কারখানার কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছিলো। জাপানিদের প্রযুক্তিতে কাজের অগ্রগতি বেশ ভালই হচ্ছিলো। অনেকদিন পর কর্মস্থল সাভারে যোগদান করলাম। প্রকল্প ব্যবস্থাপক আলম ভাই আমাকে স্বাগত জানালেন। উনি বড় ভাইয়ের মতই আমাকে স্নেহ করতেন। বললেন, চলো ল্যাবরেটরি হয়ে ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখাই, এখন তুমি চিনতেই পারবে না। অনেক পরিবর্তন। আমার অফিস কারখানার ল্যাবরেটরির ভেতর। চমৎকার সাজানো অফিস। ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে এক তরুণ আমাকে ছালাম দিলো। আমি বললাম তুমি কে? বললো, আই চগিরে না চ্যার, আই আন্নের হিয়ন। বুঝলাম ওর নাম ছগির। সে আমার পিয়ন। এ ভাষার সাথে আমার পরিচয় আছে। কারণ কাকতালীয় ভাবে আমাদের বাড়ির কাজের লোক কেন জানি নোয়াখালী অঞ্চলের হতো। বললাম নোয়াখালী কোথায় বাড়ি তোমার? সে বললো আইর বাড়ি হেনি। বললাম, তোমার নাম চগির না ছগির। সে বললো, আইর এলাকায় আইরে চোগিড়্যা বুলাইলে আই কি করতাম। আমার চেয়ারের পেছনে মস্ত এক তোয়ালে ঝুলছে, বললাম, এখানে তোয়ালে কেনো? ছগির মিয়া বললো, কি তা কন চ্যার! আইন্ন্যে একজন বড় ওফিচার, আইন্ন্যের চেয়ারের হীচে দি তোয়াইল্ল্যা থাকত ন তয় গামচা থাকতো নি। ছগির মিয়ার কথায় আলম ভাই হাসছিলেন। আমি হেসে বললাম, ঠিক আছে ওটা বাথরুমে রেখে দিও। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছগির মিয়া আমার স্নেহ ভাজন হয়ে গেলো। ছেলেটি বেশ সহজ সরল।

আলম ভাই আমাকে বললেন, চলো ফ্যাক্টরি ও আশপাশের এলাকা ঘুরে আসি। ছগির মিয়াও আমাদের পেছন পেছন হাটা দিলো। ফ্যাক্টরির ভিতরে এলাহি কান্ড প্রায় সাত আটশো শ্রমিক ও কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ চলছে। শ্রমিকদের সিংহ ভাগের বাড়ি নোয়াখালী, কারণ এদের প্রায় সবাই পিপলস সিরামিক্সে চাকুরী করতো, এখানে বেতন বেশি তাছাড়া তাদের কাজের অভিজ্ঞতার কারণেই এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুনেছি ওরা খুবই কর্মঠ, কাজে ফাঁকি দেয়া ওদের রক্তে নেই। ওদের কারণেই হয়তো ছগির মিয়ার এখানে আগমন।

আমরা ফ্যাক্টরি পেছনে রাস্তার ওপাশে গোডাউনের দিকে হাটা দিলাম, আগে ওখানে যেতে একটা কাঠের পুল পার হতে হতো, কারণ নিচে একটি খাল আছে, বর্ষাকালে খালটি পানিতে পূর্ন হয়ে যায়, গোডাউনে ট্রাক ঢোকার জন্য সেতুটি পাকা করা হয়েছে। আলম ভাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, বললেন, আমি এটা হানিকম্ব ডিজাইন করেছি। সাথে সাথে পাশে থেকে ছগির মিয়া বলে উঠলো, আইন্নে কি তা কন চ্যার! অহনে ন হানি কম বন্যায় হানি বাইরতো ন? ওর কথায় দুজনেই হেসে উঠলাম। আলম ভাই ওকে বললেন, তুমি চায়ের ব্যবস্থা করো যাও। সব শেষ করে আমার অফিসে দেখলাম তোয়ালেটা তখনও আমার চেয়ারের পেছনে ঝুলছে। আমি তাকে না সরানোর কারণ জিজ্ঞেস করলাম সে যা বললো তাতে বুঝলাম ওটা ওখানে থাকতেই হবে, তা না হলে অন্যন্য পিওনের কাছে সে হেরে যাবে। কারণ বুঝে ফেলেছি ওর যান যাবে তবুও তোয়ালে রেখে আমার আমার মান রক্ষে করবেই। তার ইচ্ছাকে সন্মান জানিয়ে আর কখনই কিছু বলি নি।

কারখানা চালু না হয় পর্যন্ত আমার যা কাজ ছিল তা সম্পন্ন করে ফেললাম। পরের সপ্তাহে জাপান থেকে প্রকৌশলী আসবে তখন বেশ ব্যস্ততা যাবে। আপাতত তেমন কোনো কাজকর্ম নেই। সাভার কলেজ আর জাহাঙ্গীরনগরে আড্ডা দিতে যাই মাঝে মাঝে। আফসার আহমেদ ওখানে নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। একদিন আফসার বললো, তুই তো কবিতা লিখতি আমাকে দিস তো পত্রিকায় দেবো। বললাম, দোস্ত খামাখা ঝামেলা করিস না ওসব অখাদ্য জিনিস না ছাপানোই ভালো। সে নাছোড়বান্দা আমার কাছ থেকে কয়েকটি কবিতা নিয়েই ছাড়লো। আমারও মনে মনে ইচ্ছে ছিলো। যা হোক তার পর ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কারখানা চালুর করার কাজে। প্রায় রাতদিন কাজ করে তিন মাসের মাথায় ট্রায়াল প্রোডাকশনে গেলাম। সে কি আনন্দ, আমার ফর্মুলায় সিরামিক্সের প্রথম প্রোডাকশন। একদিন নিজের অফিসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি লাম, তন্দ্রার মত এসেছিলো। জেগে দেখলাম আমার টেবিলে খবরের কাগজ। আমি অবাক হলাম কারণ খবরের কাগজ খুব একটা পড়ি না, শুধু হেড লাইনে চোখ বুলাই। আমি ছগির কে বললাম, এখানে খবরে কাগজ কেন? তার কথায় বুঝলাম জাহাঙ্গীরনগর থেকে বন্ধু আফসার পাঠিয়েছে, চকিতে আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো, তাহলে কি শেষ পর্যন্ত আমার কবিতা ছেপেছে ! যা ভেবেছিলাম তাই। আনন্দে আমার ল্যাবরেটরির সহকর্মীদের বললাম দেখো আমার কবিতা ছেপেছে। তাদের পড়ার আগ্রহ না থাকলেও বাধ্য হয়ে চোখ বুলালো, বসের কবিতা বলে কথা। তার কিছুদিন পর থেকেই লক্ষ্য করছি ছগির মিয়া আমাকে কি যেন বলতে চায় কিন্তু না বলে ঘাড় চুলকে আবার চলে যায়। ভাবলাম হয়তো টাকা পয়সার ব্যাপার হতে পারে। ওরা যা বেতন পায় তা দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা ছাড়া গত্যান্তর নেই। আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম তাকে অর্থ সাহায্য করার জন্য।

একদিন সে আমাকে একা পেয়ে বললো, চ্যার এক্কান কতা কইতাম। বললাম, কি কথা বলো। সে আবার ঘাড় চুলকে বললো, কইতাম চাই তয় শরমে কইতাম ফাড়ি না। আমি বললাম, তোমার টাকা পয়সা লাগবে না কি? সে বললো, আস্তাগফেরুল্লা, আইনন্যে কি তা কন, আই কিল্লাই টিয়া চামু, আইড় বাপের খেতি জমি জমা ম্যালা, আইয়ের গুষ্টি খাইয়া শ্যাষ করতে হাইরতো ন। হেল্লাই হ্যাতে তিন বিয়া কইরচে বুজ্জেন নি, আইয়ের টিয়া হুইসার অবাব আছে নি? আই চারকি করি শকে। অন্য কতা কইতাম। আমি টাকার কথা বলে বেশ অপ্রুস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, ঠিক আছে বলো। সে যা বললো তাতে আমার অবাক হবার পালা। সে নাকি কবিতা লেখে, কবিতার একটা খাতা বানিয়েছে। বই প্রকাশ করার ইচ্ছা। আপাততঃ পেপারে ছাপলেই সে খুশি। আমার বন্ধুর পরিচিত খবরে কাগজ আছে তা জেনে সে খুবই পুলকিত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন , জীবনানন্দের দেশের বাঙালি কবিতা লিখবে না তা কি হয়? আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, বাহ্ বেশ তো! তা তুমি কি ধরণের, মানে কি নিয়ে লিখ? তার বর্ণনায় বুঝলাম সে বিভিন্ন ঋতু ও শিশুদের জন্য ছড়া লিখে। আমি ওকে বললাম, ‘ঠিক আছে আমাকে দেখিয়ো তোমার কবিতা’। আমি কবিতা বিশারদ না হলেও, কবিতার বিশেষজ্ঞ মানে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। আমি বেশ আনন্দিত হলাম, ওকে সমীহের চোখে দেখতে লাগলাম। সে কবিতার বই ছাপাতে চায় কিন্তু তার পরিচিত কেউ না থাকায় পারছে না। একবার অনেক কষ্টে এক প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলো। তার কবিতা দেখে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এবং বলেছিলেন তার কাছে যেন ভবিষ্যতে দেখা করার চেষ্টা না করে। কি অপমান! আমি বললাম, ‘তুমি নিয়ে এসো চেষ্টা করে দেখতে পারি’। বেশ কিছুদিন কেটে গেলো, একদিন হঠাৎ আমার টেবিলে একটা খাতা। খাতার উপরে লেখা “বিস্ময়” । বুঝলাম পিয়ন কবিতার খাতা আমার টেবিলে রেখে লজ্জায় পালিয়েছে। বাহ্! সুন্দর নাম তো “বিস্ময়’। ভাবলাম পরে ওর কবিতা পড়ে দেখবো, অনেক ব্যস্ততার কারণে খাতাটা ড্রয়ারে রেখে দিলাম। সব সময় দেখি ও আমার সামনে ঘোরাঘুরি করে আর করুন চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে। অফিসের কাজের চাপে বেমালুম ওর কবিতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন দুপুরে খাবার বিরতিতে পিয়নকে ডেকে ওর কবিতার খাতা খুললাম। প্রথম কবিতার দু’লাইন পরে ওর “বিস্ময়’ কবিতায় আমি বিস্মিত হলাম। আমি (আমার স্মৃতির পাতা থেকে লিখছি, কিছুটা পরিবর্তনও হতে পারে) তার দু’একটি কবিতা বা ছড়া উপস্থাপন করছি।

সৃষ্টির বিস্ময়

আলেয়ার আলো তুমি দেখিয়েছো কভু

এমন বিস্ময় সৃজিলেন প্রভু।….

প্রকৃতির বিস্ময়

ঘাস খায় গরু, কাঁধে তার চিল

বিল ভরা মাছ, করে কিলবিল।…… (ব্র্যাকেটে লেখা ছোটদের ছড়া)

 

আমি বললাম, তুমি লেখাপড়া কতদূর করেছো?

উত্তর, আই কেলাস টেন হর্যন্ত হরচি, টেস্ট হরিক্কায় হাস দিচিলাম তয় মেট্রিক হাস করি ন। আমি বললাম, এখন তো আর মেট্রিক নাই এস এস সি।

বললো, আইর গেরামে আমরা মেট্রিক কই, ব্যাবাক মাস্টরও মেট্রিকই কয়, আই কিতা কৈরতম ?

বললাম, কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা কে?

উত্তর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

বললাম, বাহ্। বেশ তো! নজরুলের কবিতা কি ভাবে তোমাকে উৎসাহ দিয়েছে।

চ্যার, কিতা কইতাম, আই আন্ডার মেট্রিক হ্যাতেও আন্ডার ম্যাট্রিক। আমার বিস্ময় আর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। নিজেকে সংযত রেখে তাকে বুঝিয়ে বললাম, তিনি আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়, তাঁর সম্পর্কে এমন কথা আর কখনো বলে না বুঝলে? কবি নজরুল ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলে তিনি অনেক লেখাপড়া করেছেন। তাঁর উপর গবেষণা করে মানুষ ডক্টরেট ডিগ্রী নিচ্ছে। ওনার সাথে নিজেকে কখনোই এভাবে তুলনা করবে না। উনি সমগ্র বাংলার শীর্ষস্থানীয় কবি।

আমার কথায় সে তার আমার কথায় তার ঘাড় নিচু করে সম্মতি দিলো, তারপর তার কবিতার খাতার বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে ভাবলেশহীন ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা চুলকে, ঘাড় নিচু করে বললো, আইন্ন্যে কিতা কন, হ্যাতে তো ডাক্তর না, কবি। হ্যার উরফে গোবষণা কইরা কিল্লাই মাইনষে ডাক্তর অইতো! তয় মেডিকল কলেজ কিলাই আচে।

 

—-বায়াজীদ গালিব, ক্যালগেরী, ক্যানাডা।

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন