ছোটদের পাতা ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

স্মৃতি রোমন্থন ।।।।। প্রজ্ঞা চৌধুরী প্রাপ্তি

স্মৃতি রোমন্থন ।।।।। প্রজ্ঞা চৌধুরী প্রাপ্তি
 
আমি প্রজ্ঞা চৌধুরী (প্রাপ্তি) মৌলভীবাজার The Flower’s K G & High School থেকে  চলিত ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ সনে অনুষ্টিত Ssecondary School Certificate পরীক্ষা সমাপ্ত করে স্মৃতি এবং শ্রুতি থেকে কিছু বাস্তব উপলব্ধি share করার চেষ্টা করছি। সম্মানীত পাঠককূল অবশ্যই আমার ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
 
         আমাদের ভারতবর্ষে একটি অবাঞ্ছিত রীতি রয়েছে- উচ্চ মার্গীয় লোকজন প্রায়শই তার থেকে নিচু শ্রেণীর লোকেদেরকে মানুষ বলে গণ্য করতে রাজি থাকেননা। এ উঁচু-নিচু বংশমর্যাদা কিংবা কাজ অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্মানে। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে, জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো আবার কারোর ক্ষেত্রে সেটিও মূখ্য বলে মনে হয় না । কেউ কেউ শুধু “GOLDEN TOUCH” এর বর পেয়ে নিজের মহামূল্যবান সম্পদ হারিয়ে একজন ভালো রাজার পদের বদলে “Grasp all lose all” গল্পের সেই লোভী কৃষক পত্নীর পদপ্রাপ্ত হন। হারানো সম্মানটুকু Robart Bruce এর মতো সপ্তম প্রয়াসে পুনরুদ্ধার করার মানসিকতাও তাদের খুব একটা থাকেনা। তাঁরা ব্যক্তিজীবনে কেবল অর্থকেই প্রাধান্য দেন। এটি যে আসল মুক্তা-মানিক্যের বদলে মরীচিকার পেছনে ছোটা, তা তাঁদের বোঝাবার আকিঞ্চন থেকে বোধ হয় হিমালয়ের শৃঙ্গে চড়ে নিজের নামাঙ্কিত ধ্বজা সোল্লাসে উড়িয়ে বিশ্বের ইতিহাসে স্থান করে নেয়া মনে করি কিঞ্চিত সোজা।
 
        আজ আমি আমার জীবনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সম্পর্কে বলার চেষ্টা করবো।যাঁরা চিরকাল আমার জীবনে অবিস্মরণীয় বা বরণীয় হয়ে থাকবেন আমার প্রতি তাঁদের অগাধ প্রেম ও স্নেহ মিশ্রিত ভালোবাসায় দরুন। যাঁদেরকে সমাজের কিছু উচু শ্রেণীর লোক সুযোগ পেলে কুৎসিত – কদাকার মুখভঙ্গিমা বা ব্যবহার দ্বারা গো- ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। যার ফলে তাঁদের অনেকক্ষেত্রে অপ্রতিভ পরিস্থিতির শিকার হতে হয় কিন্তু স্বীয় মহিমামণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে তাঁরা হাজার অপমান ও কটুকথা সত্ত্বেও পাল্টা জবাব দেননা এবং তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে উঁচু শ্রেণীর মানব-মানবী বলে আমি বিশ্বাস করি। 
        
          আমার জন্মের বেশ আগে থেকেই “সরলা পিসি” আমাদের বাড়িতে গৃহকর্মে সহায়তা করতেন। ঠাম্মার কাছ থেকে শোনা গল্পে প্রাসঙ্গিক ভাবে আমার জন্মকালীন সময়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি পরম যত্ন সহকারে আমার অসুস্থ এবং প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী জননীর অকৃত্রিম সেবা করেছেন সেই কথাগুলো শ্রুত হয়ে তাঁর প্রতি  আমার শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। অবশ্যই কথাগুলো মা- ঠাম্মাদের কাছে গল্পে শোনা। মা- বাবা দুজনেই সরকারি চাকুরে থাকার কারণে শৈশবে তাঁদের সান্নিধ্য দিনের বেলা পাওয়া সম্ভব হতো না। সরলা পিসি খাইয়ে দিতেন। আমি ছোটোবেলা থেকেই একটি  চঞ্চল মস্তিষ্কের প্রাণী। এক জায়গায় বেশিক্ষণ শান্তচিত্তে বসা আমার ধাতে ছিলনা। পিসি যখন খাওয়াতেন তখন একজন বৃদ্ধা-বয়স্কা মহিলাকে আমার কি যে জ্বালাতন সে আর বলার কথা নয়! কখনো বা তাঁর চুলের খোঁপা খুলে দিলাম, কখনো মায়ের ওড়না দিয়ে তাঁর হাত-পা বেঁধে রেখেদিতাম। তাঁকে আমি কখনো রাগতে দেখিনি। তিনি তাঁর নামের মতোই শান্ত ও সরল স্বভাবের মানুষ ছিলেন।  একদিন তিনি তাঁর বাগানের ঐতিহ্যবাহী চাপাতার ভর্তা খাইয়েছিলেন আমাকে। বিকেলে ঠাম্মা যখন TV দেখতেন, তখন “বধুবরণ” সিরিয়ালের দুই মুখ্য চরিত্র কনক ও সাত্ব্যকিকে তাঁর ‘গন্নক’ ও ‘সার্তকী’ বলে ডাকা আমার খুব মনে পড়ে। তিনি সাপ ভয় পেতেন। একদিন ছোটো ভাই প্রাঙ্গণ তাঁর গায়ে নকল সাপ ছেড়ে দিলে তিনি খুব ভয় পান। সে আমার আর প্রাঙ্গণের কী মজা! ” পিসি নকল সাপেও ভয় পায়!” তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল – যখন আমার ঠাম্মার CANCER 4TH STAGE এ। তিনি তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী ‘মসীকে’ শেষ বারের মতো দেখতে এসেছিলেন ছেলে ধনুদাদাকে সাথে নিয়ে।
 
      এবার আসা যাক পঞ্চমী পিসির কথায়- তিনিও আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে আছেন। পঞ্চমী পিসি যখন আমাদের বাড়িতে থাকতেন, তখন আমি খুব ছোটো। হয়তো বছর দেড়-দুই । তাঁর সাথে রান্নাবাটি খেলা আমার খুব মনে পড়ে। একবার আমার মামাবাড়িতে মা ও আমার সাথে পঞ্চমী পিসিও যান। কারণ আমার মতো দস্যু প্রকৃতির জীবকে একা হাতে সামলানো মায়ের কম্ম ছিলনা। নাকের জলে চোখের জলে এক হতে হবে। ফেরত আসার সময় মামারা মায়ের জন্য উপহার দেখালে সবথেকে দামী শাড়িটা ধরে বললাম, এটা আমার পঞ্চুপিসির শাড়ি। সেই শাড়িটা পরে তাকেই দেওয়া হয়েছিল।ফলে আমি খুব খুশি হই। তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়, আমার বাড়িতে ২০১৬ সালে আয়োজিত অষ্টপ্রহর নামসঙ্কীর্তনে।
 
       এখন যাঁর কথা না বললেই নয়, সে হলো আমার শঙ্করী দিদি। যখন সে আমাদের বাড়িতে গৃহকর্ম সহায়িকা হিসাবে আসে  তখন তাঁর বয়স ১২-১৩ বছর হয়তো হবে। সে আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। তাঁর সাথে সমস্ত রকম দুষ্টুমী খুব ভালো জমতো। ফ্রিজ থেকে চুরি করে চকলেট খাওয়া,TV তে গান চালিয়ে নাচা, বাড়িতে কেউ এলে তার ভাগের মিষ্টি যেত আমাদের পেটে, এমনকি ঠাম্মাকে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ খেতাম দু’জনে। একদিন আমার কুট্টিপিসি ( বাবার ছোটো বোন) আমাদের বরফ খেতে দেখলে বাড়িতে সে এক বড় ধরনের লঙ্কাকাণ্ড ঘটে। সে স্মৃতির রোমন্থন এখন করছি না। কেউ কোনোকিছু রাগতস্বরে বললেই বলতাম, “শঙ্করী মাচ্চে”। হয়তো বা কখনো কখনো মারামারি ও করতাম। বিকেলে ঠাম্মার পাকা চুল বেঁছে দেওয়া, ঠাম্মার কাছে টুনা-টুনির গল্প শোনা আরো কত কী! শঙ্করীদিদি একবার আমাকে ভাত খাওয়ানোর নাম করে সব ভাত বাড়ির  পিছনদিকে স্থিত ড্রেনে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে ফেলে ঘরে এসে মাকে বলল, প্রাপ্তির খাওয়া শেষ। মায়ের সন্দেহ হয়, ” আমার প্রাপ্তিকে খাওয়াতে ২-৩ ঘণ্টা সময় যায়, আর তোর কাছে এতো কম সময়ের মধ্যে খাওয়া শেষ!”শঙ্করীদিদির কাছে কোনো সদুত্তর না পেয়ে মা তাঁর ডিটেক্টিভ মাইন্ড অন করে শেষ পর্যন্ত শঙ্করী দিদির অপরাধ আবিষ্কার করেই ফেললেন।তারপর তাঁকে কী যে বকা তা আর বলার কথা নয়।
সংবাদটি শেয়ার করুন