ফিচার্ড লেখালেখি

অতীতের ডায়েরী থেকে – ভবিতব্য | সুশীল কুমার পোদ্দার

অতীতের ডায়েরী থেকেভবিতব্য | সুশীল কুমার পোদ্দার

আজ ক’দিন হল এক সৌখিন বিষণ্ণতায় পেয়ে বসেছে আমায়। দূর দূরান্তে চেয়েও কোথাও কোন আনন্দের চিহ্ন খুঁজে পাইনা। বিমর্ষ শীতের অবগুণ্ঠন গুটিয়ে প্রকৃতি কেবল জেগে উঠতে শুরু করেছে। বৃক্ষ লতা সে সংবাদ পেয়ে তরি ঘড়ি করে জেগে উঠতে যেয়ে আবারো থমকে দাঁড়িয়েছে। আকাশ, বাতাস এখনো শীতের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি। জুনের এ সময়েও রাত্রে শীত জেঁকে বসে। সে শীতের ছোবলে আমার বাগানের চারা গাছগুলো বড় কষ্টে রাত্রি পার করছে। ওদের কষ্ট আমায় ছুঁয়ে যায় – আমার এ সৌখিন কষ্ট মনে হয় ওদেরই জন্য। ওরা যখন মুষড়ে থাকে আমি গভীর মমতায় ওদের পাতায় হাত রাখি। ওরা আমার হাতে গা এলিয়ে দেয়। আমি ফিসফিস করে বলি – এইতো আর কটা দিন – সামনে ভালো দিন আসছে।

মনটা ভালো করার জন্য মনকে জিজ্ঞেস করি আচ্ছা তুই কি খেতে চাস? মন বলে জল সিঙ্গারা, তালের শাস, সজনে পাতা ভাজি, ঝরে পড়া সজনের ফুল আর ছোট্ট লতি সজনের চর্চরী, কাঠালের ইঁচড়, মাচআলু, গন্ধ মাদনের বড়া, ধবধবে বগা পুষ্পের ভাজি…। আমি মনকে থামিয়ে দেই নিষ্ঠুর ভাবে। এ বিদেশ বিভূঁইয়ে কোথায় পাব ওদের? রান্না ঘরে ফ্রিজ খুলে দেখি কিছু করা যায় কিনা ! ফ্রিজের এক কিনারে একটা পাত্রে পড়ে আছে কিছু বাসি ভাত। হঠাৎ করে মনে পড়ে ভাত দিয়ে এক অনন্য এক খাবারের কথা। খেয়েছিলেম সেই নেত্রকোনাতে। মুঠি করা শুকনো ভাত গরম তেলে ছেড়ে দিয়ে সেই ভাতের ফুল্লরির উপর চিনি ছিটিয়ে দিয়ে খেতে কি এক অপার্থিব অনুভূতি। বাসায় কেউ নেই, তাই আমি চেষ্টা করে যাই। গরম তেলের পরশ পেয়ে ভাতগুলো মুহূর্তে ফুলের মতো পাপড়ি মেলে ধরে – মনটা তা দেখে ভালো হয়ে যায়। মনে মনে বলি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হে নেত্রকোনা। এই যে আমার সুখের অসুখ এতো তুমিই দিয়েছে। এই যে বিদেশের মাটিতে দেশের জন্য আকুতি সে সুযোগ তো তুমিই দিয়েছ। আমি ফিরে যাই সেই গ্রামের স্নেহ মাখানো নেত্রকোনার যাপিত জীবনের কাছে।

নেত্রকোনা, কি সুন্দর এক নাম! বাংলার চোখের কোনে এক অবহেলিত এক গ্রাম্য শহর, যার নেই কোন চাকচিক্য, নেই কোন সুরম্য অট্টালিকার বৈভব , রাস্তা ঘাটে অস্তিত্ব জাহির করার জন্য লাইট পোস্টে স্বল্পোজ্জ্বল লাইট জ্বলে থাকে। রাস্তাঘাট বলতে একটা দীর্ঘ সড়ক লোকালয় ছেড়ে চলে গেছে দূরে বহু দূরে। এই পথ দিয়ে হেটে যেতে যেতে কতো বার মনে হয়েছে এই সেই পথ যে পথ দিয়ে হেটে গেছেন, কবিবর নির্মলেন্দুগুণ , হুমায়ুন আহমেদ, কুদ্দুস বয়াতি আর কতো মহান ব্যক্তি। আমি সময় পেলেই ঐ রাস্তা ধরে অজানা গন্তব্যের দিকে হেটে চলি, কখনো কখনো আমার পথের সঙ্গী হয় আমার নেত্রকোনা জীবনের একমাত্র ছায়া সঙ্গী ফারুক। পথে যেতে যেতে ও আমায় ওর জীবনের অনেক নিগুর কথা অকপটে বলে যায়। ওর নিকটতম আত্মীয় বাবরের কথা বলে, ওদের গ্রাম খালিয়াজুরীর কথা বলে। জলমগ্ন ধানক্ষেত, সাগরের উত্তাল তরঙ্গ ভরা হাওরের জলরাশি, নৌকা ভাসিয়ে বড় বড় মাছ ধরার গল্প আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ওর মানুষকে সহসা আপন করার কি অফুরন্ত ক্ষমতা! পথে যার সাথে দেখা হয় সেই তার আত্মীয়। ও আমায় অযাচিত ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। গ্রাম্য মানুষ আমার পরিচয় পেয়ে হকচকায়ে যায়, মাথা নিচু করে থাকে। বিনীত ভাবে বলে স্যার ঐ যে বটগাছটা দেখছেন ওখানেই আমার ঘর, এক গ্লাস পানি খেলে খুশী হব। আমি না করতে পারিনা, সবকিছু ভুলে যেয়ে ওদের আতিথেয়তা গ্রহণ করি। কথা পাঁচকান হয়ে পোঁছে যায় ডিসি সাহেবের কানে। উনি আমায় সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেন আমি ম্যাজিস্ট্রেট, সাধারণ মানুষের সাথে চলাফেরা, কথাবলা আমায় মানায় না। আমি অর্বাচীনের মতো মাথা নাড়ি আর মনে মনে পালানোর পথ খুঁজি।

ম্যাজেস্ত্রেসী আমার দ্বারা হবে না, এ আমি বুঝে ফেলেছি। অসৎ হবার মতো দুঃসাহস যে আমার নেই । সততা দেখানোর মতো নৈতিক মনোবলে আমার তখন চির ধরেছে। আমি তাই নিয়মিত পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে চলেছি। খবর আসতে শুরু করেছে কেবল। অথচ প্রকৃত খবর যে ঐ টেবিলের উপর বিছানো মলিন খবরের কাগজের মাঝে কে জানতো ! ফারুক আমায় নিমন্ত্রণ করেছে ওর ভাইয়ের বাড়ীতে। অনাড়ম্বর জীবন ওদের। এক টেবিলের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করছে ওর ভাবী। আমার চোখ খবরের কাগজের দিকে। মুরগীর ঝোল পড়ে একটা অঞ্চল হলুদ হয়ে আছে – সেখানে এক বিজ্ঞাপন। জাপান সরকারের মনবুসু বৃত্তির বিজ্ঞাপন। আবেদন করার শেষ তারিখ আগামীকাল। আমি নখ দিয়ে বিজ্ঞাপনটা কেটে পকেটে রাখি। আমি যে আমার পকেটে সেদিন আমার ভবিতব্যকে রেখেছি তা বুঝতে পারিনি। আজ ভাবি মানুষ যেমন সুযোগের প্রতীক্ষায় উৎ পেতে বসে থাকে, তেমনি হয়তো সুযোগও বসে থাকে নিজকে ধরা দিতে…

চলবে…

অতীতের ডায়েরী থেকেভবিতব্য | সুশীল কুমার পোদ্দার ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন