ফিচার্ড লেখালেখি

২৬ মার্চ, আজ বাংলাদেশের ৫২তম মহান স্বাধীনতা দিবস ।। বিদ্যুৎ ভৌমিক

২৬ মার্চ, আজ বাংলাদেশের ৫২তম মহান স্বাধীনতা দিবস ।। বিদ্যুৎ ভৌমিক

আজ ২৬ মার্চ  বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার দিবস। বাঙালির জাতির জীবনে মহান স্বাধীনতার দিবস একটি অনন্যসাধারণ একটি দিন। বীরত্ব ও সৎসাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় এ দিনটি। ব্রিটিশ শাসনাধীন দুইশ বছরের উপনিবেশিক শোষণ ও শাসন এবং পাকিস্তানী দুঃশাসনের ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার দিন হল গৌরবোজ্জ্বল ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। তৎকালীন বিশ্বাসঘাতক ও রক্তলিপ্সু  পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে নরঘাতক  কাপুরুষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাদের সব মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে মধ্যরাতে গণহত্যার নিষ্ঠুরতম নীলনক্সা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে তাদের ভয়ংকর মৃত্যুক্ষুধা মেটাতে  দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। পাকিস্তানী নরঘাতকরা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পিলখানা, ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের বাসস্থানে হামলা চালায় এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে ভয়ংকর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সর্বত্রই এরা চালালো বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব চালিয়েছিল রাস্তায় রাস্তায়। আজও বাঙালি জাতি নরঘাতক  কাপুরুষদের কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠে।  হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন কী করেনি পাকিস্তানির বর্বর বাহিনী সেদিন। নরঘাতক ও রক্তলিপ্সু কাপুরুষদের এহেন জঘন্য হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতনে সহযোগীতা করেছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলসামস্ বাহিনী। ২৫শে মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওযা হউক- সেই ন্যার্য দাবী আমরা সকলেই আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি। এ ভয়ংকর নিধন কর্মসূচির মধ্য দিয়েই শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মসের নিরন্তর মহান স্বাধীনতা  ও মুক্তির লড়াইয়ে বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি।

সেদিন ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র জনতা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার বলিষ্ঠ চেতনায় উদবুদধ হয়ে স্বা‌ধীনতার মশাল ও অস্ত্র হাতে নিয়ে রক্তলিপ্সু পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই মহান স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তৎকালীন ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনার এই সময়টি ২৬ মার্চ জাতি নিবিড় আবেগের সঙ্গে স্মরণ করে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ইংরেজীতে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটির বাংলা অনুবাদ হলো ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানে আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে তিনি বাংলায় যে ভাষণটি দিয়েছিলেন সেটি হলো ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিয়ার ঘঁাটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে । আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি।’ এর আগে জাতির পিতা ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) দাঁড়িয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।   বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৭ই মার্চ বাংগালী জাতির প্রতি  ভাষণের মাধ্যমে  স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন । আর স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলো ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ বাংলার গণমানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে। নিজস্ব রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তথা চূড়ান্ত লড়াই ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকেই শুরু হয়। ২৬ মার্চ হল বাংলাদেশের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস। ভারতের সাহায্য ও সহযোগীতায় ৯ মসের নিরন্তর মহান স্বাধীনতা   ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয় বাঙ্গালী জাতি। অবশেষে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন ও দুলক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হলো একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর। আমার প্রাণপ্রিয় অসাম্প্রদায়িক পিতাও মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছিলেন। আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের মহান স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার ৫২ বছরে মহান স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে  বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল বাষ্ট্র হিসাবে  রাষ্ট্রসংঘের স্ীকৃতি পেয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান স্বাধীনতার ৭৬ বছর পর পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, ঝুকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বব্যাপীই বদনাম কুড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের ৫২তম মহান স্বাধীনতা দিবসে আসুন আমরা শপথ করি, যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, জীবনপণ শপথ নিয়েছিল, ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা  -তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকার, রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ সহ আমাদের সবার। স্বাধীনতা বিরোধী উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী  চাঙ্গা হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উছিলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু যথা হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসীদের উপর হামলা চালাচ্ছে,আক্রমণ চালাচ্ছে ও হুমকী দিচ্ছে, এসব উগ্র মৌলবাদী দল ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে  আবারও ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের আবেদন জানাচ্ছি বর্তমান সরকারকে। ২৫শে মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাক সেটাই আমরা সবাই চাই। মহান স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকীতে আমাদের আরও শপথ হউক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধ করা, ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাপ্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, সর্বোপরি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ,  আমাদের বীরগাথা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে নূতন প্রজন্মকে জানানোর দায়বদ্ধতা সরকার, রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ সহ আমার আপনার অর্থাৎ আমাদের সকলের। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করছি মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল শহীদদের প্রতি। আপনাদের সকলের প্রতি রইলো ৫২তম মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা,  ভালোবাসা ও অভিনন্দন।

বিদ্যুৎ ভৌমিক, কলামিষ্ট, লেখক ও সিবিএনএ’এর উপদেষ্টা। মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা২৫ মার্চ, ২০২৩ খ্রী:

 


 

সংবাদটি শেয়ার করুন