ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

নন্দন | সিদ্ধার্থ সিংহ

আংশিক গ্রাফিক সদেরা সুজন বাকী আংশিক সংগৃহিত
নন্দন | সিদ্ধার্থ সিংহ

পাড়ায় ঢোকার অনেক আগেই নন্দনের মাথা নিচু হয়ে গেল। অথচ এই ক’দিন আগেও পাড়ায় ঢোকার আগে গলির মুখে যে চায়ের দোকানটা  আছে, সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে কয়েক প্রস্থ‌ চা খেয়ে তার পর বাড়ির দিকে পা বাড়াত। কিন্তু এখন!

বিয়ে করাটাই ওর ঝকমারি হয়েছে। পাঁচ মাসও হয়নি বিয়ে করেছে, তার মধ্যেই এই! অষ্টমঙ্গলার গিঁট খুলতে শ্বশুরবাড়ি গিয়েও ও দেখেছিল, ওর বউ ভরদুপুরে কিছুক্ষণের জন্য উধাও। শ্বশুর-শাশুড়ি শালা-শালিদের জিজ্ঞেস করেও কোনও সদুত্তর পায়নি। কেউ বলেছে, এই তো একটু আগে এখানে ছিল। বাব্বা, বউকে তো চোখে হারাচ্ছ দেখছি… কেউ বলেছে, আশপাশে ওর এত বন্ধু, আবার কবে দেখা হবে! তাই হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। আবার কেউ বলেছে, জানি না তো! তবে যেখানেই যাক, তোমাকে ছেড়ে নিশ্চয়ই বেশি দূরে যাবে না।
ও মনে মনে বলেছে, যাবে না‌ সে তো জানি, কিন্তু গেছে কোথায়!
তখন অতটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু বাড়িতে আসার পরে ওর মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তা হলে কি সবাই যা বলাবলি করছে, তা-ই‍! না হলে কাউকে কিছু বলা নেই কওয়া নেই এক-দু’দিন পর পরই এই ভাবে হুটহাট করে বেরিয়ে ও কোথায় যায়! জিজ্ঞেস করলে এটা ওটা বলে ঠিকই, কিন্তু কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
একবার বলেছিল, ভাই ফোন করেছিল। বলল, মায়ের শরীরটা নাকি খুব খারাপ। ওটা শোনার পর থেকেই মনটা কেমন কেমন করছিল। তাই মাকে একটু দেখতে গিয়েছিলাম।
পর দিন যখন শাশুড়ির শরীর কেমন আছে জানার জন্য ও ফোন করল, শাশুড়িই ফোনটা ধরলেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে ও বেশ বুঝতে পারল, তিনি দিব্যি আছেন।
আরও একদিন বলেছিল,‌ ওদের পাশের বাড়ির যে মেয়েটির কাছে সবাই ব্লাউজ বানায়, বিয়েতে পাওয়া শাড়ির সঙ্গে থাকা তিনটে ব্লাউজ পিস নাকি ও তার কাছে বানাতে দিয়েছিল। আজ সেটা দেওয়ার কথা ছিল। তাই গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখে সেগুলো এখনও হয়নি।
আরও একদিন বলেছিল, ওর ছোট্টবেলার বন্ধু রণিতার বাবার নাকি গত কাল রাতে হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়েছিল। তাই আজ ও তাঁকে দেখতে গিয়েছিল।
কোথায় গিয়েছিলে? একবারে জিজ্ঞেস করলেই হল, ওর ঠোঁটের কাছে যেন সব সময় উত্তর রেডিই থাকে। কখনও কখনও ভুলে গিয়ে ক’দিন আগে বলা অজুহাতটাই আবার বলে ফেলে।
নন্দন সব বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, ও মিথ্যে বলছে। তবু সরাসরি ও কখনও তাকে কিছু বলে‌ না। বুঝতে পারে, গোটা পাড়া ওর বউয়ের এই চালচলন নিয়ে কানাঘুষো করে। ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আশপাশের মেয়েবউরা কেমন করে যেন তাকায়। ওকে আড়চোখে দেখে। নিজেদের মধ্যে কী সব যেন বলাবলি করে। এমনকী, চায়ের দোকানে যে সব বন্ধুদের সঙ্গে ও আড্ডা মারত, আজকাল তারা পর্যন্ত নানা‌ কথা‌ বলা শুরু করেছে। এই তো কিছু দিন আগে এক বন্ধু বলেছিল, কী রে, তোর বউকে তো আজকে দেখলাম দুপুরবেলায় খুব সেজেগুজে কোথায় যেন যাচ্ছে। কী ব্যাপার রে?
ও কোনও উত্তর দেয়নি। না শোনার ভান করে‌ যেই অন্য প্রসঙ্গে যেতে চেয়েছিল, অমনি পাশ থেকে একজন বলে উঠেছিল, কোনও পার্টটাইম জব-টপ করে নাকি?
ও কথা ঘোরাতে চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ও পাশ থেকে অন্য আর একজন ফোড়ং কেটেছিল, ও কী করবে? বউ সুন্দরী হলে এগুলো একটু-আধটু মেনে নিতেই হবে বাবা।
না, ও আর এ সব মেনে নিতে পারছিল না। তাই ওদের এড়িয়ে চলার জন্য যে-অলিগলি দিয়ে ও কোনও দিনও যাতায়াত করেনি, সেই গলি, গলির গলি, তস্য গলি দিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে ও এখন বাড়ি ফেরে।
আজও সেই ভাবেই ফিরছে।
কী করা যায়! কী করা যায়! হাজার ভেবেও যখন কোনও কূলকিনারা পাচ্ছিল না, তখন ওর সব চেয়ে বিশ্বস্ত, ছোটবেলার এক বন্ধুকে ব্যাপারটা বলেছিল। সেই বন্ধুই ওকে বলেছিল, আগে ভাল করে খোঁজখবর নে।‌ ও কোথায় যায়। কার সঙ্গে মেশে। তার সঙ্গে ওর কত দিনের সম্পর্ক। ছেলেটা কেমন…
— ছেলেটা কেমন জেনে আমি কী করব? আমি কি আমার মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেব?
বন্ধুটি বলেছিল, না না, আমি সে কথা বলছি না। বলছি, দেখছিস তো চার দিকে কী হচ্ছে। ঘরে স্বামী থাকতে বাইরে প্রেম করছে। বাধা দিতে গেলেই প্রেমিকের সঙ্গে যোগসাজশ করে স্বামীকে খুন করিয়ে দিচ্ছে। তাই বলছি, যা করবি ঠান্ডা মাথায় করবি। আগে খোঁজ খবর নে। না হলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।
— ঠিকই বলেছিস। এখনকার মেয়েদের আর বিশ্বাস করা যায় না। হ্যাঁ, এত বড় একটা জীবন,‌ কাউকে ভাল লাগতেই পারে, কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্কে‌ জড়িয়ে পড়তেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তা হলে খামোকা আমাকে‌ বিয়ে করতে গেলে কেন?
বন্ধুটি বলেছিল, শোন,‌ আগেই মাথা গরম করিস না। ভাল করে খোঁজখবর নে।
নন্দন বলেছিল,‌ না রে, খোঁজখবর নেওয়ার কিছু নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যার সঙ্গে ও দেখা করতে যায়, তার সঙ্গে ওর নিশ্চয়ই গভীর একটা সম্পর্ক আছে, না হলে কি কেউ‌ রোজ রোজ কারও সঙ্গে এই ভাবে দেখা করতে যায়?‌ আমি আর পারছি না রে… এর মধ্যে আমি একদিন ওকে বলেওছিলাম, তোমার সঙ্গে যদি কারও কিছু থেকেও থাকে, সেখান থেকে বেরিয়ে এসো। বিয়ের আগে তুমি কার সঙ্গে কী করেছ, আমার জানার দরকার নেই। জানতেও চাই না। পাস্ট ইজ পাস্ট। চলো, পুরনো সব কিছু ভুলে আমরা দু’জনে নতুন করে আবার জীবন শুরু করি।‌ তবু…
— শোন, ভেঙে পরিস না। তোকে যা বললাম, আগে সেটা কর। দরকার হলে কোনও প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগা। এখন তো এ‌‌ রকম সংস্থা প্রচুর গজিয়ে উঠেছে। বলেই, ও একটা ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে ফোন নম্বরও। এরা নাকি ওর বোনের বিয়ের আগে পাত্রপক্ষের যাবতীয় খোঁজখবর এনে দিয়েছিল।
নন্দন সেই দিনই ওই সংস্থায় ফোন করেছিল।
কয়েক দিন আগে খেতে বসে নন্দন ওর বউকে বলেছিল, ভাবছি এ বার একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করব।
— মানে? লাফিয়ে উঠেছিল ওর বউ। না না, আমি কোনও বাচ্চা মানুষ করতে পারব না।
— সে কী! বাচ্চা মানুষ করতে পারবে না মানে? দু’দিন পরে যখন তোমার বাচ্চা হবে, তখন?
ওর বউ বলছিল, যখন হবে তখন দেখা যাবে। হুঃ, বাচ্চা অ্যাডপ্ট করবে। ও সবের মধ্যে আমি নেই। বলেই গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মনে মনে বলেছিল, আমি জানি, তুমি কেন বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে চাইছ। তুমি ভেবেছ‌, আমি কিছু বুঝি না, না?
পরে একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ছেলেরা ভাবে মেয়েদের ঘরে বেঁধে রাখার সব চেয়ে বড় ছেকল হল একটা বাচ্চা। ভাবে, বউদের হাতে একটা পুতুল ধরিয়ে দিলেই হল। তা হলেই সে সব ভুলে গিয়ে ওই পুতুল নিয়েই সারাদিন মেতে থাকবে।
নন্দন ওর বউয়ের মুখের দিকে ঝট করে তাকিয়ে বলেছিল, তাই নাকি?
— তাই নাকি মানে? এমন ভান করছে যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। তুমি কী ভেবেছ, আমি বুঝতে পারছি না, তুমি হঠাৎ‌ করে কেন বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে চাইছ? যেহেতু এর মধ্যে আমাদের বাচ্চা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই আমি যাতে বাড়ি থেকে বেরোতে না পারি, সে জন্য তুমি একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে চাইছ, কী? তাই না?
তার‌ পর থেকে একদিন দু’দিন ছাড়া ছাড়াই এই বাচ্চা অ্যাডপ্ট করার কথা বলতে লাগল‌ নন্দন। আর প্রতিবারই ওর বউ বলতে লাগল— না না না।
গত‌ কাল রাতেও এই নিয়ে ওদের মধ্যে কথা হয়েছে। কথা থেকে মন কষাকষি। বাকবিতণ্ডা। চাপানউতোর। তর্কাতর্কি। সেই তর্কাতর্কির মধ্যেই ওর বউ রেগে‌ গিয়ে বলে ফেলেছিল, তুমি যে ভাবে খুশি চেষ্টা করতে পারো। আমাকে কিন্তু আটকে রাখতে পারবে না। আমি যেমন বেরোই, ঠিকই বেরোব।
শেষে ঝগড়াটা এতটাই চরমে উঠেছিল যে, ও আর খাটে শোয়নি। খাট থেকে এক টানে বালিশটা নিয়ে সোজা ঘরের মেঝেয় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছিল।
সেটা দেখে ওর বউ একটু বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। স্বামী মেঝের উপরে এ ভাবে শুয়ে থাকলে সে খাটে শোয় কী করে! তাই খাটের ওপরে ঠায় বসেছিল সে। যখন আর থাকতে পারছে না, চোখ বুজে আসছে ঘুমে, তখন নন্দন যাতে খাটে গিয়ে শোয়, সে জন্য ওর বউ নানা ভাবে অনুনয় বিনয় করতে‌ লাগল। গায়ে মাথায় হাত বোলাতে‌ লাগল। তাতেও যখন ডাল গলল না, তখন ওর বউও খাট থেকে একটা বালিশ নিয়ে নন্দনের পাশে শুতে গেল। অমনি ঝট করে উঠে বসে নন্দন বলল, তুমি কি এখানে শোবে? তা হলে আমি কিন্তু বেরিয়ে যাচ্ছি। আর বাড়ি ফিরব না। এটাই হবে আমার শেষ যাওয়া।
শেষে কিছুতেই যখন নন্দনের রাগ ভাঙাতে পারছে না, বুঝতে পারছি ব্যাপারটা খুব খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে, তখন বাধ্য হয়েই ওর বউ ‌বলেছিল, তুমি তো একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে চাইছ? ঠিক আছে, তুমি যা ভাল বোঝো, করো। আমি কিন্তু ওই বাচ্চার কোনও দায়িত্ব নিতে পারব‌ না। তুমি সামলাতে পারবে তো?
নন্দন বলেছিল, পারব।
আগেই সমস্ত পেপার ওয়ার্ক রেডি হয়ে গিয়েছিল। যে অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চাটি নিয়ে আসছে, তার কর্তৃপক্ষকে ও আগেই বলে দিয়েছিল, আজ সন্ধ্যের দিকে গিয়ে বাচ্চাটিকে ও নিয়ে আসবে।
সেই মতো বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। বেরোনোর আগে ও যখন চা খাচ্ছে, ওর বউ‌ ওর কাছ ঘেষে দাঁড়াল। শেষবারের মতো আস্তে আস্তে করে বলল, বাচ্চাটাকে না আনলেই নয়?
নন্দন ওর বউয়ের দিকে এক ঝলক তাকাল। কিন্তু কোনও উত্তর দিল না।
রাত তখন আটটা সওয়া আটটা হবে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই নন্দনের বউ বুঝতে পারল নন্দন এসেছে। নন্দন যে কাকে নিয়ে আসছে, সে ছেলে না মেয়ে, কালো না ফর্সা, তার বয়স কত, তাকে দেখতে কেমন, ও কিচ্ছু জানে না।‌‌ ওর পা আর চলছে না। কোনও রকমে দোতলা থেকে আস্তে আস্তে একতলায় নেমে‌ এল‌ সে।‌‌ আর দরজা খুলতেই এক্কেবারে থ’। নিজের চোখকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না।‌ মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তার পরেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করতে লাগল সে। কপালে, গালে, ঠোঁটে, মাথায় চুমু খেতে খেতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল— তুমি ওকে কোথায় পেলে?
— যে অনাথ আশ্রমে দু’-একদিন ছাড়া ছাড়াই তুমি ওকে দেখতে যাও,‌ সেখানে।
— তুমি জানলে কী করে?
— আমি সব জানি।‌জানি তোমার সঙ্গে রক্তিমের মেলামেশার কথা। তোমার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা। তুমি যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন হঠাৎ করে তার পালিয়ে যাওয়া। তোমাকে দেখে ডাক্তার বলেছিলেন, এই অবস্থায় অ্যাবরশন করাতে গেলে তোমার জীবন সংশয় হতে পারে। তাই তোমার বাড়ির লোকেরা তোমাকে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যখন ও হয়, তার কয়েক মাস পরেই তোমরা ওকে রেখে আসো ওই অনাথ আশ্রমে। কিন্তু কেন? ও তো কোনও দোষ করেনি। তা হলে মা থাকতেও ও কেন মায়ের‌ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে?
অবাক হয়ে গেল ওর বউ— তুমি সব জানো?
— জানি। আমি সব জানি। আমি তো‌ তোমাকে আগেই বলেছিলাম, পাস্ট ইজ পাস্ট। যা হয়েছে, হয়েছে। সব ভুলে যাও। এখন শুধু তুমি, আমি আর ও। তুমি কি ওকে আমাদের সন্তান মনে করে ভালবাসতে পারবে না?
নন্দন দেখল, তার বউ তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
নন্দন | সিদ্ধার্থ সিংহ -লেখক কথাসাহিত্যিক-গল্পকার, ভারতের আনন্দ পাবলিশার্সসহ বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক
সংবাদটি শেয়ার করুন