ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

বিজন প্রান্তর হইতে এক পশলা স্নিগ্ধ বাতাস হু হু করিয়া ছুটিয়া আসিল। মুহূর্তে তাহা ছড়াইয়া পড়িল বটবৃক্ষের পাতায় পাতায়। পাতারা আন্দোলিত হইল, শিহরিত হইল। সেই শিহরণে বৃক্ষের সর্বাঙ্গ সারা দিয়া মাতিয়া উঠিল অজানা এক অপার্থিব সুরে। অবলা বিমুঢ় হইয়া শুনিয়া গেল সেই অপার্থিব সুর। মর্মর ধ্বনিতে হাহাকার করিয়া বৃক্ষ হইতে ঝড়িয়া পড়িল রাশি রাশি শুকনো পাতার ফুলঝুরি। অবলাকে ঘিরিয়া ওরা রচিয়া চলিল এক ঘূর্ণাবর্ত। সেই ঘূর্ণাবর্ত অবলার অতীত জীবনের সমস্ত গ্লানি, সমস্ত ক্রন্দনকে ধুইয়া মুছিয়া তাহাকে বর্তমানের মাঝে ছাড়িয়া দিয়া আস্তে আস্তে অন্তর্হিত হইল। অবলা বাস্তবে ফিরিয়া আসিল। চোখের জলে স্নাত হইয়া নিজকে অনেক হাল্কা বোধ করিতে লাগিল। মুহূর্তে তাহার মনে উদিত হইল এক গভীর শঙ্কা – কেউ কি দেখিয়া ফেলিয়াছে তাহার এই নীরব ক্রন্দন, তাহার এই উচ্ছ্বাসিত অশ্রুজল?

বিবেক তাহার পানে চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল – অবলা, যে অশ্রুজল তোমার জমাট বাধা কষ্টকে দ্রবীভূত করিয়া ভাসাইয়া লইয়া গেল তাহার জন্য তুমি লজ্জিত বোধ করিতেছ? তোমার মিথ্যা পৌরুষ, মিথ্যা সংস্কারবোধ তোমায় এতদিন ভুল পথে চালিত করিয়াছে। তুমি শরীর লইয়া বাস করিলেও নিজের শরীরকে চিনিতে পার নাই।

জান অবলা, সাফল্যকে ছিনিয়া আনিতে হইলে মানুষকে জীবনের কতো শ্বাপদ সংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়। তুমি চলিতে গেলে হোঁচট খাইবে, বাধা পাইবে, ভাঙিয়া পড়িবে, তুমি শোকে দুঃখে অধির হইবে, আশাহত হইয়া বিলাপ করিবে। কিন্তু সেই বিলাপ, সেই শোক, সেই আশাহত হইবার বেদনা তোমার শরীর মনকে যেন দীর্ঘস্থায়ী কোন অবসন্নতায়, গভীর কোন হতাশায় বাধিয়া ফেলিতে না পারে, তুমি যেন ভাঙ্গিয়া পড়িয়া তোমার শরীরের বড় কোন ক্ষতি না করিয়া ফেল – তাহার জন্য প্রকৃতি তোমায় দিয়েছে এই অশ্রু জল। নির্বিচারে গ্রহণ কর সেই মহার্ঘ উপহার। কাঁদ সবার সামনে, চোখের জলে তোমার বুক ভিজিয়া যাক, উহাকে রোধ করিতে যাইও না। নদীর সততঃ ধারাকে রোধ করিলে গেলে নদী তার গতি হারাইয়া ফেলে, জমা হয় পলির আস্তরণ। তেমনি তুমি তোমার আবেগ উত্থিত ক্রন্দনকে রোধ করতে গেলে শরীরে জমা হইবে স্ট্রেস হরমোন সহ অজস্র বিষাক্ত রাসায়নিক।

জান অবলা, তোমার অগোচরে তোমার অশ্রুজল সেই সব বিষাক্ত রাসায়নিকে দ্রবীভূত করিয়া তোমায় বিষমুক্ত করিয়া চলিতেছে। শুধু তাই নয় – বেদনাহত মানুষ যেমন অপিয়ডে নেশা করিয়া সব ভুলিতে চায়, তেমনি তোমার ক্রন্দন তোমার মস্তিষ্কের কাছে অপিয়ড ভিখ মাগিয়া, তাহা তোমার শরীরে ছড়াইয়া দিয়া তোমায় সাময়িক ভাবে প্রদান করিতেছে ভাল লাগার, স্হীতধী হইবার সুব্যবস্থা।

তোমরা পুরুষেরা ছোট বেলা হইতে শুনিয়া আসিয়াছ – পুরুষের কাঁদিতে নাই। তোমরা আস্তে আস্তে বড় হও, সম্মুখীন হও দুঃখ, শোক, ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি সহ কতো অসহনীয় বাস্তবতার। তোমরা দগ্ধ হও ভেতরে ভেতরে। চোখে জল আসিলেও তোমরা অনায়াসে বলিয়া ফেল -কৈ আমার তো কিছু হয়নি; হয়তো বা চোখে কোন কিছু পরিয়াছে। তোমরা তোমাদের কষ্টকে রুদ্ধ করিতে যাইয়া নেশাগ্রস্থ হও, কেউ আত্মহননের পথ বাছিয়া নাও। অথচ কেউ যদি তোমাদের ছোট বেলা হইতে শিক্ষা দিতো – কষ্টকে ভেতরে পুষিয়া রাখিও না, তাহা হইলে তুমি তোমার কষ্টকে আর দশজনের মাঝে প্রকাশ করিয়া কষ্টের সুতীব্র ধারকে অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয় করিয়া দিতে পারিতে। তুমি পাশে পাইতে তোমার সমব্যথীকে – যারা তোমার ব্যথায় সহানুভূতির প্রলেপ দিয়া তোমাকে কাছে টানিয়া লইত।

বিবেকের সান্নিধ্যে অবলা তার কষ্টকে মুহূর্তে ঝাড়িয়া ফেলিয়া বটবৃক্ষের প্রাঙ্গণ হইতে বাড়ির পথে পা বাড়াইতে উদ্যত হইলো। হঠাৎ তার চোখে পড়িল বটবৃক্ষের গাত্র -বাঁকলে অজস্র উৎকীর্ণ অস্পষ্ট নাম। সেইসব উৎকীর্ণ লিখনি তাহাকে ফিরিয়া লইয়া গেল কৈশোরের অর্বাচীন দিনগুলোতে। তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল এক সলজ্জ হাসি। শৈশব কৈশোরের বন্ধুদের কথা মনে পড়িল। বয়ঃসন্ধিকালে তাহার কিছু দুষ্ট বন্ধু এ গাছের গাত্রে অকথা কুকথা লিখিয়া রাখিত। তাহা লইয়া বন্ধুরা সবাই মিলিয়া চটুলতায় মাতিয়া উঠিত। মাঝে মাঝে তাহাদের কদর্য আচরণ লোকলজ্জার গণ্ডী অতিক্রম করিয়া ফেলিত। একদিন তাহাদের অসুস্থ আচরণ গুরুজনদের কর্ণগোচর হইল। এই বটবৃক্ষ তলে রাত্রে হ্যাজাক জ্বলাইয়া তাহাদের বিচার হইলো। দুষ্ট বন্ধুদের সাথে তাহাকেও কান ধরিয়া উঠ-বস করিতে হইলো। সেই কথা মনে হইতেই তাহার চোখ মুখ লজ্জায় রক্তিম আকার ধারণ করিল।

বিবেক তাহাকে দুখের যাতনা হইতে মুক্ত করিয়া অতীতের এক রোমাঞ্চকর স্মৃতির মাঝে ছাড়িয়া দিয়া এক গভীর আনন্দ বোধ করিতে লাগিল। নতমুখ অবলাকে বিস্ময়ভরে জিজ্ঞাসা করিল – আচ্ছা অবলা, তোমাদের সময়ের গাছের বাকলে, শৌচাগারে, বিদ্যালয়ের দেওয়ালে, বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের ব্লকগুলোর উপর প্রেমিক প্রেমিকাকে জড়াইয়া যে অরুচিকর, কুরুচিকর কথা লেখার সংস্কৃতি ছিল, তাহা কি আজ দেখিতে পাও? দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন কি সংস্কার হইলো যে অসংস্কৃতবান বকাটে ছেলেরা সেই অপসংস্কৃতি ছাড়িয়া দিয়া রাতারাতি সংস্কৃতিবান হইয়া গেল? কক্ষনো কি ভাবিয়া দেখিয়াছ? অবলার কান আবারও লজ্জায় লাল হইয়া উঠিল। তাহার মনে প্রশ্ন জাগিয়া উঠিল – তাহা হইলে কি ওরা সবাই ফেসবুকে আশ্রয় লইয়াছে!!

 

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন