ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স || পর্ব – ১৪ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ রয়
পূর্ব প্রকাশের পর। পর্ব- ১৪
দুপুরের ফ্লাইটে রমলা আর প্রাণতোষ দিল্লি পৌঁছালো। ওদের দিল্লির অফিসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হরি সিং ওদের জন্য গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল। এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে ওরা দিল্লির পাঁচতারা হোটেল তাজমহলে গিয়ে উঠলো। হরি সিং ওদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে জানিয়ে দিল ,বিকেল পাঁচটার সময় এই হোটেলের লাউঞ্জে মিটিং বসবে। হরি সিং সেই সময় ঠিক তৈরী হয়ে চলে আসবে। হোটেলের রিসেপশন থেকে হরি সিংকে বিদায় জানিয়ে ওরা নিজেদের রুমে গেল। তারপর প্রাণতোষ আর রমলা বাথরুমে ঢুকল৷ শাওয়ারের জলের ধারায় মৈথুনে মগ্ন হল।
তারপর দুপুরে খাবার পর দুজনে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। দুজনের চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম পাখি।
বিকেল সাড়ে চারটে বাজলেই প্রাণতোষ এর ঘুম ভেঙে গেল। রমলার দিকে তাকিয়ে দেখল গভীর ঘুমে মগ্ন। রমলাকে ও আর ডাকল না। তৈরি হয়ে একতলায় লাউঞ্জে চলে গেল। গিয়ে দেখল ,সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাণতোষ যাবার পর হরি সিং চায়ের অর্ডার দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেয়ারা ট্রেতে করে সাদা চিনামাটির টিপটে গরম চা আর সাদা কাপ প্লেট নিয়ে এল। তারপর সবাইকে চা পরিবেশন করে সেলাম ঠুকে চলে গেল। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রাণতোষ এর খুশির আমেজ এসে গেল। তারপর সে মিটিং এর আলোচনা শুরু করল।
মণীশ আগরওয়াল , রাজেশ ত্রিপাঠী , মহেশ ত্রিবেদী ,হরি সিং আর প্রাণতোষ মোট পাঁচ জনকে নিয়ে আজকের মিটিং।
রাজেশ ত্রিপাঠি প্রথম শুরু করল ৷ মিস্টার দত্ত দিল্লির শাহিনবাগ এলাকায় আমার একটা পুরনো রাবারের কারখানা আছে। ওটা এখন বন্ধ৷ আমি সেটা কাজে লাগাতে চাই। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমার জায়গাটা ব্যবহার করতে পারবেন সেখানে ইলেকট্রিকের সরঞ্জাম তৈরি করা যাবে আমাকে প্রফিট থেকে একটা অংশ দিলেই চলবে৷
ত্রিবেদী বলল, মিস্টার দত্ত ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ভাববেন না। ও আমি করব। প্রফিট এর থেকে একটা পার্সেন্টেজ আমি নেব।
দিল্লির ব্যাপারটা পুরোটাই হরি সিং দেখে। প্রাণতোষ হরি সিং এর দিকে তাকাল। হরি সিং চোখের ইশারায় প্রাণতোষকে হ্যাঁ বলে দিতে বলল৷
প্রাণতোষ সব শুনে তারপর কথা শুরু করল। খুব আস্তে আস্তে প্রাণতোষ বলল ,তার মানে ত্রিপাঠিজি আপনি জমি দিচ্ছেন। ত্রিবেদীজি আপনি ইনভেস্ট করছেন। আর ব্যবসায় মগজ খাটাচ্ছি আমি। এবার বলুন আপনাদের এতটা সাহায্য করার কারণ কি?
ত্রিপাঠি এবং ত্রিবেদী দুজনেই বলে উঠল, আপনার ইলেকট্রিক্যাল জিনিসপত্র যেগুলো কলকাতা থেকে সড়ক পথে আসে সেগুলো দিল্লি,পাঞ্জাব ,হিমাচল প্রদেশের কিছু অংশে খুব ভালোভাবে বাজার দখল করে নিয়েছে। সেটা আমরা জানি।
আপনার এখানকার অফিস ম্যানেজার হরি সিংয়ের সঙ্গে গিয়ে এই ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি। ওকেই আমরা বলেছি এখানে এইসবের যদি একটা ফ্যাক্টরি খোলা যায়। তাহলে প্রোডাকশন আরও দ্বিগুন হবে। আর জিনিসের যেহেতু চাহিদা আছে ,যত প্রোডাকশন হবে, তত বিক্রিও হবে।
তারপরই হরি সিং আপনার সঙ্গে কথা বলেছে।
প্রাণতোষ সব কথা শুনে বলল।
ঠিক আছে কালকে সকালে তাহলে আমরা গিয়ে কারখানাটা দেখে আসি। যদি সব কিছু ফাইনাল হয়ে যায় তাহলে আমি এখান থেকে সিমলা কুলু মানালি ঘুরতে যাব। হরি সিং সব কাগজপত্র রেডি করে রাখবে। ফেরার পথে আমি এগ্রিমেন্ট পেপারে একেবারে সই করে কলকাতায় রওনা দেব।
ত্রিপাঠি এবং ত্রিবেদী দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, বহুত খুব বহুত খুব।
হরি সিং বেয়ারাকে ডাকল। প্রাণতোষ সবার জন্য হুইস্কির অর্ডার দিল। সঙ্গে সোডা ওয়াটার। আর তার সঙ্গে ফিশ ফ্রাই।
রমলা ঘুম ভেঙে দেখল। তার পাশে প্রাণতোষ নেই। সে বুঝল প্রাণতোষ বিজনেস মিটিংয়ে গেছে। সে ঘুমাচ্ছিল বলে আর ডাকেনি। ঘুম থেকে ওঠার পর রমলার শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। এক কাপ চা পেলে বেশ ভালো লাগবে। রমলা বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকল। বেয়ারা আসার পর চায়ের অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যেতেই রমলা দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর দেওয়াল জোড়া বড় কাঁচের জানলার সিল্কের পর্দা সরিয়ে জানালার সামনে এসে দাড়াল৷ সন্ধের রুপোলি আলোতে দিল্লি শহর তখন সেজে উঠেছে।
কিছুক্ষণ পরে বেয়াড়া চা নিয়ে এলো। রমলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে লাগলো প্রাণতোষ এর কথা। সারাদিন ব্যবসার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। রাতের বেলা রমলাকে বিছানায় নিয়ে যখন জৈবিক চাহিদায় মগ্ন হয়, তখন রমলার নিজেকেএকটা যন্ত্র ছাড়া কিছুই মনে হয়না। রমলার মনটা গুমড়ে উঠল৷
প্রাণতোষ যখন হোটেলের লাউঞ্জ থেকে রুমে এলো তখন রাত নটা বেজে গেছে। রমলাকে পাশে বসিয়ে প্রাণতোষ বলল ,দারুন বিজনেস অফার পেয়েছি জানো তো। যদি ড্রিল ফাইনাল হয় ,তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।
তারপরে হুশ হলো রাত হয়ে গেছে। ডিনার করতে হবে। বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে অর্ডার দিল রাতের খাবারের। হুইস্কির ঘোরে প্রাণতোষ ব্যবসার উত্তরণের বিষয়ে অনেক কথাই বলতে লাগল। রমলা স্থবির হয়ে সব শুনতে লাগল৷ এর আগে প্রাণতোষকে কখনও এভাবে সে দেখেনি। কিছুক্ষণ পরে বেয়ারা ঘরে খাবার দিয়ে গেল। প্রাণতোষ খেতে খেতেও একই কথা বারবার বলতে লাগল। হুইস্কির গন্ধে রমলার পেটটা কেমন গুলিয়ে উঠল। বাথরুমে গিয়ে গল গল করে বমি করে দিল রমলা। কিছুক্ষণ পরে বেয়ারা এসে খাবারের প্লেট গুলো নিয়ে গেল। রমলা সে রাতে আর কিছু খেলো না। প্রাণতোষ বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। রমলার রুমের লাগোয়া সার্টিনের পর্দা লাগানো বড় প্যাসেজটায় এল। এই জায়গাটাও সুন্দর ডেকোরেশন করা। একটা বড় সোফা। তার সঙ্গে একটা টি টেবিল। পাশেই একটা বড় কাঁচের জানালা। এখান দিয়ে রাতের আকাশ খুব সুন্দর দেখা যায়। আকাশের গায়ে তারার চাদর। শহুরে আলোর ঝলকানি এখানটা কম বলে রাতটা এত সুন্দর। রমলা মুগ্ধ হয়ে সে দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে তার অনুভব হল ,গুমড়ে থাকা কষ্টটা এখন আর তার নেই। দুচোখ ঘুমে ভারী হয়ে এল। রমলার বিছানায় যেতে ইচ্ছে করল না। সোফার উপরে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল।
পরদিন রোদের আলো চোখে পরতেই প্রাণতোষের ঘুম ভেঙে গেল৷ দেখল রমলা পাশে নেই৷ ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠল সে৷ দেখল রমলা ঘরের সঙ্গে বড় প্যাসেজের সোফায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে৷
প্রাণতোষ রমলাকে আর ডাকল না। রমলা কেন এখানে ঘুমাচ্ছে সেটা বুঝতে পারল। বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল রমলা উঠে পরেছে। রমলা প্রাণতোষের সঙ্গে কোনও কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে গেল। প্রাণতোষ ততক্ষণে চা আর ব্রেকফাস্ট এর অর্ডার করে দিয়েছে। রমলা বাথরুম থেকে বের হতেই প্রাণতোষ বলল, কালকে একটু ড্রিঙ্ক করে ফেলেছিলাম। তাই নেশার ঘোরে অনেক কিছুই বলে ফেলেছি। কিছু মনে করো না। বিজনেস মিটিং তো একটু-আধটু ড্রিঙ্ক না নিলে চলে না। আজকে ব্রেকফাস্ট সেরে আমি একটু বেরোবো। যেখানে আমাদের কারখানাটা তৈরি হবে সেই জায়গাটা দেখতে। লাঞ্চের আগে ফিরতে না পারলে তুমি লাঞ্চ সেরে নিও। আমি বাইরে খেয়ে নেব। ওখান থেকে ঘুরে এসে তারপর দিল্লি শহরটা একটু তোমাকে নিয়ে দেখতে বেড়োব৷
রমলা চুপ করে থাকল। ব্রেকফাস্ট সেরে প্রাণতোষ রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল।
এই চার দেওয়ালের মাঝখানে রমলার কেমন যেন দম বন্ধ হতে লাগলো? রমলা দরজা লক করে একতলায় নেমে এল। হোটেলের পেছন দিকটায় একটা সুন্দর বাগান আছে। রমলা সেই বাগানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাড়াল। সবাই যে যার মতন কাজ করছে। রমলার নিজেকে একটা যন্ত্র ছাড়া কিছুই মনে হলো না। রমলা হাঁটতে-হাঁটতে হোটেলের লাউঞ্জের দিকে এগোলো।
—আরে রমলা না।
রমলা সামনে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল সীতেশ দাঁড়িয়ে আছে। সীতেশ রমলার কলেজের বন্ধু নীতার দাদা। কলেজে পড়তে পড়তে রমলা নীতার বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছে। তখনই সীতেশের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। রমলা ওর বিয়েতে কজন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিল, তারা কেউই আসতে পারেনি। কারণ কলকাতা থেকে তাদের বাবা মায়েরা বর্ধমানে মেয়েদেরকে ছাড়েনি।
সীতেশকে দেখে রমলা বলল ,দাদা আপনি এখানে ?
——আমি যে সংবাদ পত্রিকার অফিসে চাকরি করি তাদের হয়ে রিপোর্টিং করতে এসেছি৷
———তুমি এখানে ?
আমার স্বামী এখানে একটা বিজনেসের কাজে এসেছে কাল। কালকে আমরা সকালে সিমলা কুলু মানালি ঘুরতে যাব।
——হ্যা নীতা বলছিল তোমার বিয়েতে যেতে পারিনি বলে খুব মন খারাপ করছিল।
তা ভালো আছো তো ?
রমনা মাথা নাড়ল৷
—— নীতা কেমন আছে দাদা?
———ভালো আছে। ওর তো বিয়ের জন্য আমরা পাত্র খুঁজছি।
লাউঞ্জের কোণের দিকের চেয়ার থেকে একজন ডেকে উঠল সীতেশের নাম ধরে৷
সীতেশ হাত নাড়ল তারপর রমলাকে বলল, আমার কলিগ ডাকছে। আমি চলি ? ভালো থেকো বোন।
রমলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল৷
দুপুরের লাঞ্চ রমলা একাই সারলো। প্রাণতোষের ফিরতে ফিরতে বেলা তিনটে বেজে গেল। প্রাণতোষ এসে বলল, এখানে ব্যবসা খোলার ব্যাপারে ফাইনাল হয়ে গেল। শাহীনবাগে কারখানার জায়গাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। সিমলা থেকে ঘুরে এসেই কাগজপত্রে সই সাবুদ করে তারপর কলকাতায় রওনা দেব৷ রমলা বলল, বাহ খুব ভালো খবর। প্রাণতোষ বলল, নাও তৈরী হয়ে নাও সন্ধ্যেবেলা আমরা একটু ঘুরে আসি।
—— না, আমার আজকে আর বেরোতে ইচ্ছা করছে না।
—— তাহলে তো বেশ ভালোই হলো, আমারও শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত ৷আজকে বরং রেস্ট নিই৷ কালকে সকাল হলেই তো আবার সিমলায় রওনা হতে হবে।
প্রাণতোষ রমলার পাশে বসলো। রমলার হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে বলল ,আমি যা পরিশ্রম করছি ,সবটুকুই আমাদের ভালোলাগার জন্য।
তোমাকে একা রেখে অনেকক্ষণই আমাকে বাইরে যেতে হয়েছে। আমারও মনটা খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু কিছু করার ছিলনা।
প্রাণতোষের জন্য রমলার মায়া হল। সে প্রাণতোষ এর মাথার চুলে বিলি কেটে বলল, আমি কিছু মনে করিনি। তুমি আমার জন্য এত কিছু ভাবো বলেই তো তুমি আমাকে সুখে রাখার জন্যই এত কিছু করছ তা আমি বুঝি। কিন্তু তোমার কাছে আমি একটা জিনিস চাই তুমি কি দেবে?
— বল কি চাও? আমি কলকাতায় ফিরে গানের তালিম শুরু করতে চাই।
—বাহ খুব ভালো খবর। সত্যি তো আমার ফিরতে ফিরতে কত রাত হয়ে যায়, তুমি বাড়িতে একা থাকো ৷ সেখানে গান শিখলে তোমার সময়টা কাটবে। তবে আর যাই করো বাউল গান শেখবার কথা বলো না।
প্রাণতোষের কথায় রমলা পুরোটাই বুঝল। তাই রমলা কোনও তর্কে না গিয়ে বলল, আমি কীর্তন শিখতে চাই।
প্রাণতোষ হেসে ফেললো। তারপর বলল, তুমি এই গান শিখলে পরে মা সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। মা তো ঠাকুরঘরে সবসময় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকেন।
— আমি কীর্তণ শিখছি শুনলে আমার জেঠামশাইও খুব খুশি হবেন।
রমলা আর প্রাণতোষ দুজনে খুনসুটিতে মেতে উঠলো। প্রাণতোষের সম্মতি রমলার মনে সুখের হাওয়া বয়ে এনে দিলো।
রমলা বলল ,তুমি এখন একটু বিশ্রাম করো। আমি লাগেজ গুছিয়ে নিই৷ আজকে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে৷ কালকে ভোরবেলা আবার সিমলা যাওয়ার জন্য রওনা দিতে হবে।
প্রাণতোষ বালিশের মধ্যে মুখ বুজে শুয়ে পড়ল। রমলা মহা উৎসাহে জিনিসপত্তর সব চামড়ার সুটকেসে ভর্তি করতে লাগলো।
ভোরবেলা গাড়ি চলে এল হোটেলের সামনে৷ এই গাড়ি করে ওরা প্রথমে মানালি যাবে , ওখানে তিনদিন থেকে কুলু হয়ে তারপর সিমলায় তিনদিন থেকে দিল্লী ফিরবে৷ ওরা গাড়ির সামনে আসতেই গাড়ির ড্রাইভার হুকুম সিং ওদের লাগেজ গাড়ির ডিকিতে রেখে সেলাম ঠুকলো৷
প্রাণতোষ আর রমলা গাড়ির পেছনের সিটে বসতেই হুকুম সিং গাড়ি ছেড়ে দিল৷
ওদের মানালি পৌছতে পৌছতে রাত নটা বেজে গেল৷ হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল৷ কাজেই সারাদিন জার্নির পর দুজনেই এতটাই ক্লান্ত ছিল রাতের খাবার সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল৷
কাঁচের জানালা দিয়ে সোনালী রোদ্দুর এসে ওদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল৷ ওরা কাঁচের জানালার পর্দাগুলোকে আরও সরিয়ে দিল ৷ প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত মানালিকে দেখে ওরা মুগ্ধ৷
উঁচু নিচু বরফ আর পাথুরে পাহাড়ের এক অপূর্ব সমাহার তার সঙ্গে রয়েছে কূলকূল শব্দে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আঁকাবাঁকা ভাবে বয়ে চলা বিপাশা/বিয়াস নদীর এক অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির অপার বিস্ময় পাহাড়-পর্বত আর নদী মানালিকে মোহময়ী করে তুলেছে৷
ওরা তৈরি হয়ে সকালের খাবার খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো৷ হুকুম সিংও রেডি৷ আজকে ওদের মানালির কিছু দর্শণীয় স্থান ঘোরাবে৷
হুকুম সিং ওদের হিন্দীতে মানালি সম্পর্কে বলতে লাগল৷ যার বাংলা তর্জমা হল,
হিন্দিতে মানালিকে বলা হয় “ধারতি কা সওয়ার্গ” বা “পৃথিবীর স্বর্গ”। মানালিতে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে যা একবার গেলে বার বার সেখানে ছুটে যেতে ইচ্ছে হবে।
পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ আর প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ওরা রোহতাং গিরিপথে পৌছল। এখানে শ্বেতশুভ্র সুবিশাল পাহাড়ের সারি আর বিশাল বিশাল প্রস্তর খন্ডের সঙ্গে নিজেদের মুহূর্তগুলোকে প্রাণতোষ ওর জার্মান ক্যামেরায় স্ন্যাপবন্দী করল৷
রোহতাং গিরিপথ থেকে ফেরার পথে হুকুম সিং রাহালা জলপ্রপাতের সামনে গাড়ি থামাল৷ পাহাড়ের গা বেয়ে কূলকুল শব্দ করে জলরাশি নেমে বিপাশা/ বিয়াস নদীতে গিয়ে মিশছে। অপার্থিব সৌন্দর্যে রমলার মন তখন বাঁধনছাড়া৷
সন্ধে নামার কিছুক্ষণ বাদেই ওরা হোটেলে ফিরল৷ রমলা আজ প্রকৃতির রমনীয় সৌন্দর্যে এতটাই বিভোর পথের ক্লান্তি ওর শরীর, মন কোনওকিছুতেই ছুঁতে পারল না৷
পরদিন হোটেল থেকে বের হয়ে প্রথমেই ওরা রওনা দিল শতবর্ষের পুরানো হিড়িম্বা দেবীর মন্দিরের উদ্দেশে।
রমলাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে ৷ একটা নীল রঙের শাড়ি আর তার সঙ্গে কপালে নীল টিপ৷ মুখে যেন সুখ উপচে পরছে৷
গাড়িতে যেতে যেতে রমলা বলল, হিড়িম্বা মন্দিরের গল্প জানো ?
প্রাণতোষ রমলার হাতটা ধরে বলল, তোমার মুখে শুনতে ইচ্ছে করছে৷
———মহাভারতের কাহিনী অনুসারে- হিড়িম্বা ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবের একজন ভীমের সহধর্মিণী ও বীর ঘটোৎকচের মা।
এই হিড়িম্বা কিন্তু মানুষ ছিলেন না, ছিলেন রাক্ষসী। মানালিতে তিনি দেবীজ্ঞানে পূজিত।
কথা শেষ হতেই ওরা মন্দিরের সামনে এসে গেল৷
কাঠের তৈরি মন্দিরটি দেখতে বেশ সুন্দর। মন্দিরের ভেতরে বিরাট কালো রঙের পাথর।
যা ঘিরে গড়ে উঠেছে এ মন্দির।
কথিত আছে, এই পাথরের নিচে ধ্যানে মগ্ন হতেন হিড়িম্বা।
সাড়ে ৪০০ বছরেরও বেশি পুরানো এ মন্দির যেন আজও তার স্বাক্ষর বয়ে বেড়াচ্ছে।
ওরা হিড়িম্বা দেবীকে দর্শন করল৷
তারপর মার্কেট এরিয়ায় গিয়ে মানালির বিখ্যাত কুল্লু চাদর, চেরি ফল, আখরোটসহ নানা শুকনো ফল কিনল৷
দুজনে প্রাণভরে স্ট্রবেরি আর চেরিফল খেল৷
মানালি ঘোরা শেষ করে পরদিন ওরা পাহাড়ি ঢালু রাস্তা আর বিয়াসের গর্জন শুনতে শুনতে রওনা হল সিমলার উদ্দেশে। মানালি থেকে সিমলায় যেতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা।
যাবার পথে ওরা কুল্লুতে একটি বিখ্যাত শাল ফ্যাক্টরির সামনে দাড়াল৷ সেখানে দারুণ দারুণ সব শাল ও শীতের পোশাক পাওয়া যায় বেশ সুলভ দামে। কয়েকটা শাল কিনে গাড়িতে চেপে বসল৷
সিমলায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন প্রায় সন্ধ্যা। পুরো একটি পাহাড় জুড়ে ছোট ছোট দালান, রাত হলেই সেখানে জ্বলে উঠে বাতি। যেন এক অপার্থিব দৃশ্য।
রাতটা নির্ধারিত রির্সোটে কাটিয়ে পরের দিন ভোরেই ওরা বেড়োল সিমলার সৌন্দর্য অবগাহনে। এখানে মানালির মতো অতটা ঠাণ্ডা না থাকলেও সকালে ওদের নিয়ে ড্রাইভার হুকুম সিং গেল কুফরিতে। সমতল থেকে ২৫০০ কিলোমিটার উঁচুতে এই জায়গাটি কিন্তু শীতকালেই দেখতে বেশ সুন্দর লাগে৷
একটি নাগ মন্দির, আপেলের বাগান আর টুকটাক অ্যাডভেঞ্চার রাইড ছাড়া দর্শনীয় কিছুই সেখানে নেই৷
তবে কিছুটা রোমাঞ্চকর ওদের লাগল যখন উঁচু পাহাড়ে ঘোড়ায় চড়ল ৷ কুফরি দর্শন শেষে ওরা বের হল সিমলার আরও একটি দর্শনীয় স্থান হনুমানজীর মন্দিরে, যা ঝাঁকু টেম্পল হিসেবে পরিচিত।
পুরাণ মতে, রামায়াণে রামের ভাই লক্ষ্মণকে সুস্থ করতে সঞ্জীবনীর সন্ধানে বেরিয়ে এই পর্বতে আসে হনুমান। ৮ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ মন্দিরটি যেন বানরের অভয়ারণ্য৷
এখানে রয়েছে হনুমানজীর ১০৮ ফুটের একটি বিশাল আবক্ষ মূর্তি। যেটা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্যের মধ্যে অন্যতম ৷
প্রাণতোষ প্রাণ ভরে ওর ক্যামেরায় ছবি তুলতে লাগল৷ রমলাও খুব খুশী৷ একদিন প্রাণতোষ একদম ছেলেমানুষ হয়ে রমলাকে জড়িয়ে রাখল৷
সিমলায় দুদিন থেকে তারপর ওরা দিল্লী ফিরল৷
হরি সিং সব রেডি করেই রেখেছিল৷
ব্যবসার কাগজপত্তরে প্রাণতোষ সই সাবুদ সেরে ফাইনাল করে বিকেলের ফ্লাইটে রমলাকে সঙ্গে করে কলকাতায় রওনা দিল৷
চলবে…
কৃষ্ণা গুহ রয়- উপন্যাসিক, কবি। পশ্চিমবঙ্গ
অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে হলে
পর্ব -১ পর্ব -২ পর্ব -৩ পর্ব -৪ পর্ব – ৫ পর্ব – ৬ পর্ব – ৭ পর্ব – ৮ পর্ব – ৯ পর্ব – ১০ পর্ব – ১১ পর্ব-১২ পর্ব-১৩
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান