ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ১৩ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য়

 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ১৩ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য়

পূর্ব  প্রকাশের পর। পর্ব- ১৩

তারপর সদানন্দ  প্রাণতোষের হাত ধরে বললেন,  ও  যদি ছেলে মানুষি করে , কোনও ভুল করে,  ওকে তুমি  বুঝিয়ে বোলো,  দেখবে  ও ঠিক শুনবে৷

রমলাকে  সদানন্দ বললেন,  মা  শ্বশুরবাড়িতে সবাইকে  আপন করে নেবে৷  স্বামীর কাছে  কোনও কথা গোপন করবে না৷

আমাদের এই বাড়ির যেন কোনও অসম্মান না হয় ৷ যদি তোমার সম্পর্কে  কোনও  নালিশ আসে ,আমাদের কাছে  সেদিনই জেনে রাখবে  আমাদের সঙ্গে  তোমার সম্পর্ক  ছিন্ন হবে৷

রমলার চোখের জল আর  বাধ মানলো না ৷ সদানন্দের বুকে ঝাঁপিয়ে  ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল৷

সদানন্দ রমলার মাথায় হাত  বুলিয়ে  বলতে লাগলেন,  চলো মা  ঘরে চলো,  তৈরী হয়ে নাও ৷ এখন তোমার  জীবনে  নতুন অধ্যায় শুরু হল৷

রমলা  শাড়ির আঁচল দিয়ে  চোখ মুছে  দোতলার ঘরে গেল৷

প্রভা সেখানে অপেক্ষা করছিল ৷ রমলার মুখ দেখেই বুঝল  রমলা কান্নাকাটি করেছে৷  প্রভা বলল , মন খারাপ করিস না  এটাই জীবনের ধর্ম ৷ যা চোখে মুখে জল দিয়ে আয়  ৷আমি তোকে এখন সাজিয়ে দিই ৷ দশটার মধ্যে বেরোতে হবে , দেরি করা যাবে না৷

রমলা চোখে মুখে জল দিয়ে এল। তারপর দেখল  নিভা  জল খাবারের প্লেট হাতে  দাঁড়িয়ে আছে৷  রমলা বলল,  মা আমার খেতে ইচ্ছে করছে না ৷ নিভা বলল  ,তা বললে তো হবে না মা,  মুখে কিছু না  দিলে  অম্বল হয়ে যাবে ৷

এই বলে  লুচি টুকরো করে  আলুর তরকারি দিয়ে  মেয়ের মুখে  পুরে দিল ৷

রমলা খেতে খেতে  মায়ের মুখের দিকে  তাকিয়ে দেখল,  মা কত শান্ত হয়ে আছে ৷

রমলা মাকে জড়িয়ে ধরল৷  নিভা বুঝতে পেরে বলল  ,এতদিন  মায়ের কাছে  যা বায়না আবদার করেছ  মা সবকিছু  মেনে নিয়েছে ৷ শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কিন্তু  এরকম করবে না ৷ বুঝে শুনে কথা বলবে, বুঝে শুনে চলবে ৷

নিভা রমলাকে খাইয়ে  ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ৷ তারপর প্রভা  রমলাকে সাজিয়ে দিল ৷

এরপর   একতলার  বড়  ঘরে  রমলা আর প্রাণতোষ  পাশাপাশি  পাতা  দুটো  চিত্র আঁকা  পিড়ি আসনে বসল  ৷ বাড়ির একে একে সবাই  ওদের মাথায়  ধান দুব্বো  দিয়ে  আশীর্বাদ করল ৷

তারপর ওরা উঠে দাঁড়াল যাবার জন্য ৷ রমলা আঁচলে চাল নিয়ে   পেছনে  সেই চাল ছড়িয়ে দিয়ে বলল,  তোমাদের ঋণ শোধ করলাম ৷

কথাগুলো বলেই  রমলা  ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল৷  নিভা এসে  মেয়েকে জড়িয়ে ধরল৷

রমলা কাঁদতে কাঁদতে বলল  ,এসব কিসের নিয়ম মা? জীবনে কখনো  বাবা মায়ের ঋণ শোধ করা যায় !

নৃপেন্দ্র বাবু  মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে বললেন , সবই জানি মা ,এসব নিয়ে তুমি ভেবো না , আমরা তো তোমার  পাশে থাকবো ৷

তুমি এখন হাসিমুখে যাও ৷

তারপর প্রাণতোষকে  ইশারা করলেন ৷ প্রাণতোষ  এগোতেই  রমলাকে নিয়ে প্রভা   এগিয়ে গিয়ে  গাড়িতে  উঠিয়ে দিল ৷ আশুতোষ বাবু  সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করে  বাড়ির গাড়ির সামনের সিটে বসলেন ৷আগে থেকেই  বরযাত্রীরা  বড় গাড়িতে   বসেছিল৷ ওরা  বাড়ির নিজস্ব  অ্যাম্বাসেডরে উঠতেই  জোকার দিয়ে  গাড়ি ছেড়ে দিল ৷

বারবেলার আগেই ওরা  কলকাতায়  আশুতোষ বাবুর বাড়িতে  পৌঁছে গেল ৷ নীলিমা   বরণ ডালা সাজিয়ে  নতুন বউকে বরণ করে  ঘরে তুললেন ৷ তারপর রমলা সাজ পোশাক ছেড়ে  খেয়েদেয়ে  দুপুরে বিশ্রাম নিল  ৷ প্রাণতোষ সবার চোখের আড়াল করে   ঘুমন্ত রমলাকে দেখেও গেল ৷ পরদিন বৌভাত  তাই বাড়িতে তুমুল ব্যস্ততা ৷ আশুতোষ বাবু  সেদিকেই ব্যস্ত ৷

প্রাণতোষ নিজের ঘরে গেল৷  সদানন্দ বাবুর কথাগুলো  তার কানে বাজতে লাগল ৷ প্রাণতোষের ঘরের জানলা দিয়ে  ব্রজেশ্বরের ঘরটা  ভালোভাবে দেখা যায়৷  প্রাণতোষ দেখল  ব্রজেশ্বর  একমনে কি ভেবে চলেছে , প্রাণতোষ মনে মনে হাসল  আপন জেঠতুতো  দাদা  জীবন সম্পর্কে পুরো উদাসীন  , অথচ সে নিজে  আজকে  এই অঞ্চলের বিত্তবানদের মধ্যে  একজন  ৷ মায়ের কাছে শুনেছিল  বাবা নাকি  ব্রজেশ্বরকে গিয়ে  তার বিয়ের কথা জানিয়েছিল , ব্রজেশ্বর বলেছিল,  ভালোতো জ্যাঠামনি  ঘরে আমাদের  রাধারানী আসছে , কি  ভেবে বলেছিল কে জানে ? আশুতোষ বাবু বলেছিলেন , তুমি বিয়েতে যাবে তো ব্রজ?  তার উত্তরে  ব্রজেশ্বর বলেছিল,  জ্যাঠা মনি  আপনি তো জানেন  আমি ঐসব লৌকিক আচার ধর্ম মানিনা  ৷আপনারাই বরং যান ৷ আমি এখানে ঠিক আছি  ৷ আর কথা বাড়াননি আশুতোষবাবু৷

প্রাণতোষ সব শুনে  মাকে বলেছিল,  ছাড়ো পাগলের কাণ্ডকারখানা৷  নাহলে নিজের পায়ে কেউ কি কুড়াল মারে ? তুই গান গাইছিস ভালো কথা কিন্তু গানটা দিয়ে  কিভাবে অর্থ উপার্জন করবি সেটা ভাব। তা নয়  উনি বামাক্ষ্যাপা সেজে  বসে আছেন ৷ ওর গুরু  বিদেশে গিয়ে  গাড়ি-বাড়ি করে ফেলল৷  আর ও   সর্বত্যাগী  সাধু বাবা হয়ে রইল  ৷ এসব ভন্ডামি বুঝলে মা ৷ আসলে ও হচ্ছে অলস৷  মাথা গোজার ছাদ আছে , চার বেলা খাবার জুটছে , হাত খরচের টাকাও পাচ্ছে  , আর কি চাই?  এও এক ধরনের  কুড়েমির লক্ষণ৷

প্রাণতোষ ঘড়ির কাঁটা দেখল ৷ সন্ধ্যে সাতটা বাজে ৷ দুদিনে শরীরটায় ধকল গিয়েছে৷ একটুও বিশ্রাম হয় নি  ৷ প্রাণতোষ জানে  বাবা খুব সময় মেনে চলে ৷ রাত ন’টা বাজবে  খাবার ডাক আসবে ৷ এই দু’ঘণ্টা হাতে সময় আছে৷  আগামী মাসে ব্যবসার কাজে  দিল্লি যেতে হবে৷  সেই ব্যাপারে  ভাবনা চিন্তাগুলো  প্রাণতোষ  টেবিলে রাখা  ডায়রিটায়  নোট করতে থাকল৷

রাত ন টা বাজতেই  খাবারের ডাক পরল৷  নিচে গিয়ে দেখল , আজকে কাল রাত্রি বলে  , রমলাকে আগে খাইয়ে  অন্য ঘরে  পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷

প্রাণতোষ  যারা বাকি ছিল  তাদের সঙ্গে খেতে বসল  ৷ দেবাশীষ প্রাণতোষের পাশে বসেই  মশকরা শুরু করল৷  আর তো কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। তারপরই  একদম বউয়ের পাশে৷

দেবাশীষ জিজ্ঞাসা করল,  কিরে হানিমুনে কোথাও যাবি ঠিক করলি? প্রাণতোষ বলল, আগামী মাসে দিল্লিতে  ব্যবসার কাজে যাব ,  ওখানে দুদিনের কাজ তারপর  সিমলা কুলু মানালি ঘুরে আসব৷  দেবাশীষ  হাসতে হাসতে  বলল,  তা বেশ  তুই কিন্তু দারুন স্মার্ট ৷ ব্যবসা আর বউ  দুটোকেই এক জায়গায়  করে  দারুন  ম্যানেজ করছিস৷  বিয়ের পরেই  বরফ  খুব ভালো।  ঠান্ডার মধ্যে গরম উপভোগ৷

প্রাণতোষ বলল, তুই থামলি৷  তুই শুরু করলে আর থামিস না , পারিসও বটে ৷

দেবাশীষ বলল,  একটাই তো জীবন ভাই  একটু তো হেসে খেলে কাটাতেই হবে৷

কথা বলতে বলতে কখন যে ওদের খাওয়া হয়ে গেল  তা ওরা টেরই পেলো না  ৷ দেবাশীষের বউ  তাড়া দিলো, তোমরা তাড়াতাড়ি ওঠো৷  সবাই যে খেয়ে দেয়ে উঠে পড়েছে ৷ শরীর আর দিচ্ছে না। ঘুম পাচ্ছে ভীষন৷

দেবাশীষ একটা হাই তুলে  প্রাণতোষকে বলল, চল চল ওঠ,  কালকে থেকে  তোর জীবনের  নতুন অধ্যায় ৷ আজকে চিরকুমারের  শেষ রজনী৷

দেবাশীষের কথায়  প্রাণতোষ  আর দেবাশীষের বউ  রত্না হো হো করে হেসে ফেলল৷

আজ বৌভাত  ৷ দুপুরবেলা  প্রাণতোষ  কাঁসার থালায়  পঞ্চ ব্যঞ্জন সহ  অন্ন সাজিয়ে  তার উপর দুটো কাপড় দিয়ে,  রমলার হাতে থালাটা ধরিয়ে বলল,  আজ থেকে তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আমি নিলাম৷

তারপর সব আত্মীয়দের  খাবার পরিবেশনের আগে  রমলা চামচে করে  ঘি ভাত  সবার  কলাপাতায় দিয়ে দিল ৷ সবাই  এরপর  খাওয়া শুরু করল৷  বৌভাতের আচার-নিয়ম  শেষ হতেই রমলা আর প্রাণতোষকে  পাশাপাশি খেতে বসিয়ে দেওয়া হল ৷ খাওয়া হয়ে গেলে   রত্না  রমলাকে নিয়ে  দোতলার কোনের ঘরটায় চলে গেল  ৷ দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল , তুমি এখন একটু বিশ্রাম কর ৷ একটু পরে তোমাকে আমি সাজাতে বসব ৷ রমলা বালিশে মাথা দিয়ে  শরীরটা এলিয়ে দিল৷ চোখটা একটু লাগতেই  কানের কাছে ভেসে এল একতারার মধুর শব্দ ৷ আরামে রমলার চোখ বুজে এল৷  ঘুমিয়ে পড়ল সে ৷

চারটে বাজতেই  দেবাশীষের বউ  চা নিয়ে এল ৷ রমলাকে  ঘুম থেকে তুলে  চায়ের কাপ হাতে দিয়ে বলল  , তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দাও ৷ রমলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল , দিদিভাই  এখানে কে একতারা বাজায় গো ? রত্না বলল,শুনেছি প্রাণতোষের জেঠতুতো  দাদা  বিয়ে থা করেনি , গান-বাজনা করে , এটুকুই জানি ,এর বেশি কিছু জানিনা ৷

কথাগুলো বলেই  রত্বা রমলাকে তাড়া দিল  , নাও ওঠো ওঠো ৷  শিগগির হাত মুখ ধুয়ে এস, সন্ধের মধ্যে তোমাকে সাজিয়ে  দিতে হবে ৷

রমলাকে  সুন্দর করে খোপা  বেঁধে  গালে  খড়িমাটির   কলকা  একে  সাজিয়ে দিল রত্না ৷ বেনারসি শাড়িতে,  মাথায় ফুলের মুকুট  , আর গলায়  ফুলের মালায় রমলাকে যেন  স্বর্গের অপ্সরী লাগছে৷

রমলাকে সাজিয়ে যখন   বউ  বসাবার  নকশা করা  বড়  চেয়ারে  বসানো হলো ৷ তখন  অতিথিদের আসা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ সবাই রমলাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে ৷ প্রাণতোষকেও পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে  বেশ লাগছে৷  সকলকেই রমলা হাতজোড় করে নমস্কার করতে লাগলো। কিন্তু মনটা তার চঞ্চল হয়ে আছে৷  আজকের দুপুরের একতারার সুর  তার মনে  সুরের মাতন তুলেছে ৷  কিছুক্ষণ পরে কনেযাত্রীরা ফুলশয্যার তত্ত্ব  হাতে  নিয়ে এসে পড়ল ৷ ওদের দেখে  রমলার মাথা থেকে  তখন আবার ওই চিন্তা সরে গেল।  প্রভা এসে  রমলাকে বলল,  বাহ তোকে তো একদম পরীর মত লাগছে ৷ নৃপেন্দ্র বাবু  বেশ খুশি  মেয়েকে  অভিজাত  ঘরে  বিয়ে দিতে পেরেছেন বলে ৷

সদানন্দ  রমলার সামনে এসে দাড়ালেন। জিজ্ঞাসা করলেন,কেমন আছো মা ?

রমলা বলল, ভাল আছি জেঠু  ৷ সদানন্দ বলল , সবসময় আনন্দে থাকবে৷  মনকে কখনও কষ্ট দেবে না  ৷ রমলা চুপ করে রইল৷ ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকল৷  কনে যাত্রীদের খাবার আয়োজন করা হয়েছে , সবাই খেতে গেল  ৷ রমলা মনে মনে ভাবতে লাগল, কত অচেনা মানুষের  মধ্যে   আজ   সে নীরব  শ্রোতা৷ তার সব কথা এখন মনের ঘরে  তালা বন্দী হয়ে পড়ে আছে ৷ শুধু কলের পুতুলের মতন   ঘাড়  নাড়াই   একমাত্র কাজ৷

খাওয়া হয়ে গেলে নৃপেন্দ্র  রমলার  মাথায় হাত দিয়ে ভালো থাকিস মা বলে রওনা দিল।  সদানন্দ দ্বিরাগমনে আশুতোষবাবুদের সপরিবারে নেমন্তন্ন করলেন।  কনে যাত্রীদের বাস ছেড়ে দিল৷ আশুতোষ বাবু বাড়ির সবাইকে তাড়া দিতে লাগলেন ,খেতে বসার জন্য।  রাতের শেষ বৈঠকে বাড়ির সবার খাওয়া হলে পরে রমলার তুতো জায়েরা রমলাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে গেল৷  বিশাল পালঙ্ক  রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে সাজানো। কিছুক্ষণ বাদে প্রাণতোষ ঘরে ঢুকল।প্রাণতোষ ঘরে ঢুকতেই ওরা মুখ টিপে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রাণতোষ গিয়ে রমলার পাশে বসল ৷ পকেট থেকে একটা আংটি বার করল। রমলার বাঁ হাতের অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিল। তারপর রমলার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল, তোমার যা অসুবিধা হবে আমাকে বলবে। রমলা মাথা নাড়ল৷ আগামী মাসের শেষের দিকে দিল্লি হয়ে সিমলা কুলু মানালি ঘুরতে যাব সেকথাও প্রাণতোষ জানাল রমলাকে। রমলা খুব খুশি হল। বলল, জানেন আমি খুব ঘুরতে ভালোবাসি। সেজন্যই তো এই ব্যবস্থা করেছি মহারানী। প্রাণতোষ এর কথা শুনে রমলা হেসে ফেলল। প্রাণতোষ  বলল, তুমি আমার থেকে কি চাও? রমলা মাথা নেড়ে বলল কিচ্ছু না।

প্রাণতোষ রমলাকে আরও কাছে টেনে নিল। রমলার কানে গালে ঠোটে  প্রাণতোষের ঠোঁট নেমে এলো। রমলা প্রাণতোষ এর প্রতিটি ছোঁয়াকে অনুভব করতে লাগলো। কাঙ্খিত সুখের আবেশে রমলা চোখ বুঝল। বাইরে বৃষ্টির ঝাপটায় রমলার মন ভিজলো তৃপ্তির শীৎকারে যা ঘরে অনুরণিত হতে থাকলো।

রাত শেষ হবার আগেই রমলার ঘুম ভেঙে গেল৷ দেখল ,প্রাণতোষ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। রমলা শাড়ি কাপড় ঠিক করে খোলা জানলার কাছে এসে দাঁড়াল৷ ভোর হতে এখনও খানিকক্ষণ বাকি। অন্ধকারেরও একটা আলো আছে। সেই আলোয় দেখল এটা বাড়ির পিছন দিক। গাছগাছালিতে ভরা। একদম নির্জন। তার মধ্যে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা ঘর। লম্বা বারান্দায় ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল একজন সৌম্যদর্শন মানুষ বসে আছেন। রমলার মনে পরল ,গতকাল দুপুরে একতারার সুর এর কথা। ওনার কথাই কি রত্না তাকে বলেছিল। রমলার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মানুষটির প্রতি।

ব্রাহ্ম-মুহূর্তে রোজই ঘুম ভাঙ্গে ব্রজেস্বরের। এই সময়টা সে বারান্দায় এসে বসে। চোখ বুজে প্রকৃতিকে অনুভব করে। শব্দ খোঁজে। নিঃশব্দ চরাচরে তখন সে নীরব শ্রোতা। জাগতিক জগতের বাইরের অপার্থিব জগতে তখন তার বিচরণ হয়। ব্রজেশ্বর অনুভব করে খোলা আকাশ ,গাছপালা উজার করে দেয়  শব্দ ভান্ডার তার কাছে। ব্রজেশ্বর সারাদিন সেই শব্দ চয়ন করে একের পর এক গানের মালা গেঁথে রাতে সুর দেয়। এক অনাবিল সুখের নিঃসরণে ভাসে সাধক ব্রজেশ্বর।

ব্রজেশ্বর জানে এই বাড়িতে সবার কাছে সে ব্রাত্য। তার জন্য সে কাউকে দোষারোপ করে না। ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়েছে সে। এই কাকাই তো তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। পড়ালেখাও শিখিয়েছেন। কিন্তু তার মন যে অন্য কিছু খুঁজে বেড়ায়৷ সেটা বা ওরা কি করে বুঝবে। সেজন্য ব্রজেশ্বরকে কেউ বিরক্ত করে না।  সামনের পাকা দোতলা বাড়িতে সে যায় না। কাকিমার বাপের বাড়ি থেকে আসা ছবি মাসি এই বাড়ির সংসার সামলায়। ছবি মাসিকেই একমাত্র ভালো লাগে ব্রজেশ্বরের। মুখ বন্ধ করে সব কাজ সামলায়৷ কারোর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। হাসিমুখে সব দায়িত্ব পালন করে চলেন। বাড়ির সব কাজ সামলেও ছবি মাসি মাঝে মাঝে ব্রজেশ্বর এর কাছে আসে। ব্রজেশ্বরকে বলেন, বাবা নতুন কি গান বাঁধলি। একটু গা না শুনি। ব্রজেশ্বর একতারা হাতে তার নতুন বাঁধা গান শোনায়। ছবি মাসি বলে পাগল ছেলে আমার।

সেই ছবি মাসি বিয়ের দিন  সবাই রওনা হওয়ার পর সন্ধ্যেবেলা ব্রজেশ্বর এর কাছে এসে অনেকক্ষণ বসেছিল। কাকিমা তখন ঠাকুর ঘরে। বলেছিল বাবা ,বাড়িতে নতুন বউ আসছে। সেও শুনেছি  ভালো গান গায়। খুব লক্ষ্মী মন্ত মেয়ে। ভালোই হবে এবার ঘরে বসেই গান শুনতে পারব। ব্রজেশ্বর হেসে বলেছিল ,বাহ খুব ভালো হবে মাসি। তোমার আর আমার কাছে ছুটে আসতে হবে না।

—হ্যাঁ,  তুইতো আর ও বাড়িতে যাবিনা। আর সব সময় তো আমি ছুটে ছুটে আসতে পারবো না। কাজেই এখন ঘরেই গান শোনাবার জন্য আমাদের নতুন বউই  আসছে।

প্রাণতোষ বলেছিল , বেশ বেশ।

জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা , চাওয়া পাওয়া সব এক জায়গায় এসে থমকে যায়। যা রমলা নিজেও জানতো না। সূর্যোদয়ের আকাশে ব্রজেস্বরকে দেখে রমলা থমকে গেল। মানুষটি যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সূর্যের কমলা রং যখন সারা আকাশে ছড়িয়ে গেল তখন ব্রজেশ্বর চোখ খুলে পেছনে ঘুরতেই দেখল জানালায় দাড়ানো বাড়ির নতুন বৌটিকে৷ পলকহীন ভাবে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রাণতোষের তখন ঘুম ভেঙে গিয়েছে। জানালায় ওইভাবে রমলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রাণতোষ আধ বোজা চোখে বলল ,ওখানে কি করছ? রমলা জানলা থেকে সরে প্রাণতোষ এর কাছে এসে বসলো। প্রাণতোষ দুই হাত দিয়ে রমলাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।

আস্তে আস্তে বাড়ি ফাঁকা হতে শুরু করল৷ বিয়েবাড়ির পর্ব শেষ। আত্মীয়-স্বজনরাও তাদের ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে রওনা দিলো যে যার বাড়ি। রমলাও আগামীকাল ভোর বেলা দ্বিরাগমনে বাপের বাড়ি যাবে। রাতের বেলা স্যুটকেসটা গুছিয়ে নিল। তখনই কানে ভেসে এলো ,মন যদি পাবোই না সই , মন পিঞ্জরে আর বাঁধিস না। রমলার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রাণতোষ ঘরে নেই। সে গিয়ে জানলার কাছে দাড়ালো। দেখল ব্রজেশ্বর একতারা হাতে একমনে গান গেয়ে চলেছে। রমলার লক্ষীদিদির কথা মনে পরল। সেও তো এখন পিঞ্জরে বাধা। বাপের বাড়ি গিয়ে কি আর লক্ষ্মী দিদির সঙ্গে দেখা করতে পারবে। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে প্রাণতোষকে রমলা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, তোমাদের বাড়ির পেছনদিকে একজন ভদ্রলোককে দেখলাম? উনি কে? প্রাণতোষ বলল, আমার জেঠুতুতো দাদা। জ্যাঠা জেঠি মারা যাবার পর আমাদের বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছে। আধ পাগলা লোক। গান নিয়ে মেতে থাকে। আমরা আছি তাই চলে যাচ্ছে। রমলা বলল, গানটা উনি বেশ ভালোই গায়। প্রাণতোষ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল! হ্যাঁ, ওই আর কি? নিজেই গান গায় নিজেই শোনে। দর্শকদের গান শোনাতে গেলে যে পরিশ্রম করতে হবে। কুঁড়েমি আর কি?

রমলা প্রাণতোষ এর মনোভাব বুঝে আর কথা বাড়ালো না। মনে মনে বলল সাধনা নির্জনেই হয়৷

পরদিন খুব ভোরবেলা গাড়ি করে ওরা রওনা দিল অষ্টমঙ্গলা সারতে। পুরো রাস্তা রমলা চুপ করেই রইল। আর প্রাণতোষ মনে মনে হিসেব কষতে লাগলো, দিল্লিতে কিভাবে ব্যবসাটাকে গুছিয়ে আসবে?

বর্ধমানের রাস্তায় গাড়ি ঢুকতেই রমলা দেখল, লক্ষী দিদি আর  গোসাই দাদা উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। রমলার মন উতলা হয়ে উঠল। প্রাণতোষকে বলল, গাড়িটা একটু দাঁড় করাবে ? প্রাণতোষ জিজ্ঞাসা করল, কেন? রমলা লক্ষী দিদিকে দেখিয়ে বলল, ওরা আমার খুব চেনা। আমি একটু কথা বলতে চাই। প্রাণতোষ পাক্কা ব্যবসায়ী লোক। সে জানে কখন কি কথা বলতে হয়। তাই কায়দা করে বলল, তুমি বাড়ি চলো। তারপর নয় বিকেলের দিকে ওদের ওখানে যাওয়া যাবে। রমলা বলল, তুমি যাবে। প্রাণতোষ বলল, হ্যাঁ, বিকেলের দিকে আমরা ঘুরতে বেরোবো যখন, তখন ওদের বাড়ি ঘুরে আসব।

রমলার দুচোখে খুশীর ঝিলিক দেখা গেল। আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল বাড়ির সদর দরজার সামনে। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে নৃপেন্দ্র বাবু বেরিয়ে এলেন। হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। এই ওরা এসে গেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।

নৃপেন্দ্রর ডাকে নিভা বরণের ডালা নিয়ে বাইরে এল। ওদের দুজনকে বরণ করে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। অষ্টমঙ্গলায় কাপড়ের গিট খুলে রমলাকে প্রভা অন্য ঘরে নিয়ে গেল। কাকিমা আর প্রভা রমলাকে নতুন শ্বশুর বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করল। রমলাও খুব সাগ্রহে এ কদিন যা যা ঘটেছে সব বলল। শুধু জমা রাখল ব্রজেশ্বরের কথা লক্ষী মনির জন্য। বেলা গড়াতেই রমলার মন ছটফট করতে লাগল৷ বাড়িতে সবাই ব্যস্ত নতুন জামাইকে নিয়ে। জামাই আদর আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি নেই। পিঠে পায়েস পুলি বিভিন্ন রকমের ভাজা, প্রাণতোষের মুখ আর বন্ধ হয় না। রমলা ছোট কাকিমাকে বলল,কাকিমা একটু লক্ষ্মী দিদিকে খবর দেবে আমি এসেছি। কাকিমা বলল, হ্যাঁ, তোকে একটা কথা বলা হয়নি। লক্ষ্মী দিদিকে বিয়েতে আসার জন্য তোর কাকা বলেছিল। কিন্তু ওর গোঁসাইয়ের প্রচন্ড জ্বর ছিল বলে আসতে পারিনি। রমলা বলল, আমিও তাই ভাবছিলাম লক্ষীদিদি তো আসবে বলেছিল। কাকিমা বলল দাড়া দেখি কাউকে দিয়ে খবর পাঠানো যায় কিনা। দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়ার পর প্রাণতোষের চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল। রমলা একতলায় নামতেই দেখল, লক্ষী দিদি দাঁড়িয়ে আছে। রমলা লক্ষ্মী দিদিকে নিয়ে টানতে টানতে একেবারে বাড়ির পেছনের চাতালে নিয়ে গেল। লক্ষ্মী দিদি বলল, ওরে ছাড় ছাড় কি করিস? রমলাও নাছোড়বান্দা। লক্ষীদিদিকে একেবারে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, গোঁসাই দাদা এখন কেমন আছে লক্ষী দিদি। এখন আগের থেকে ভালো আছে। তোর কাকিমা রতনকে দিয়ে খবর পাঠালো, তাই এলাম। তোর গোঁসাই দাদা বলল, তাড়াতাড়ি যাও দিদিমনি তোমাকে না দেখে থাকতে পারে না। আমি বললাম তুমিও চলো আমার সঙ্গে। সে বলল আমার শরীরটা এখনও দুর্বল আছে তুমিই যাও ৷লক্ষ্মী দিদি একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করল, বল দিকিনি তোর শ্বশুরবাড়ি কেমন হয়েছে?

রমলা বলল, ওনারা খুব ভালো।

— জামাই এখন কোথায়?

—তোমার জামাই ঘুমাচ্ছে গো লক্ষী দিদি। জামাইয়ের সঙ্গে তোর মনের মিল হয়েছে তো। রমলা মাথা নাড়ল। দেখ যতক্ষণ না মনের মিল না হয় ,ততক্ষন কিন্তু শরীরের মিলনে কোনও আনন্দ নেই।

রমলা চুপ করে থাকল।

লক্ষ্মীমণি হেসে রমলার চিবুক ধরে বলল, তা জামাইয়ের মনের ভেতর যে পাখিটা আছে তাকে তো পোষ মানাতে সময় দিতে হবে তো৷

রমলা হেসে ফেলল৷ তারপর খুব উৎসাহ নিয়ে  বলল, জানো তো লক্ষী দিদি তোমাদের জামাইয়ের জ্যাঠতুতো দাদা একজন বাউল সাধক। আমার ঘরের পেছন দিকটায় থাকে। উনি কারুর সামনে আসেন না। আমার জানালা দিয়ে ওনাকে দেখেছি। ভোরের নরম আলোয় যেন এক সিদ্ধ সাধক বাউল। শুনেছি ওনার নাকি বিদেশে যাওয়ারও ডাক এসেছিল। কিন্তু সাধনার বিঘ্ন হবে বলে  তিনি সেই ডাকে সাড়া দেননি।

লক্ষ্মী দিদি বলে উঠল ,সে কিরে এরকম সিদ্ধ বাউল আজকাল দেখা মেলে না। তুই কথা বলেছিস তার সঙ্গে। — না, গো দিদি। আমি যেটুকু চিনেছি। ওনার সঙ্গে বাড়ির সম্পর্ক নেই বললেই চলে।

লক্ষ্মী দিদি বলল, হুম তা তো হবেই। এরা তো প্রথাগত সমাজের বাইরে। এনাদের সঙ্গে সবার মিলবে কেন?

গল্পে গল্পে বেলা গড়িয়ে এল৷ আর কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধ্যা নামবে, লক্ষ্মী দিদি উঠে দাঁড়াল৷ এবার তাকে ঘরে ফিরতে হবে। রমলা লক্ষীদিদির সঙ্গে দালানের সামনে আসতেই, প্রভা বলল, হ্যা রে রমলা জামাই যে ঘুম থেকে উঠে তোকে খুঁজছে। রমলা লক্ষী দিদির হাত চেপে ধরে দোতালার ঘরে নিয়ে গেল।

প্রাণতোষের সঙ্গে লক্ষ্মী দিদির আলাপ করিয়ে দিল। লক্ষ্মী দিদি সুদর্শন প্রাণতোষকে  দেখে বলল, বাঃ আমার দিদিমণির পাশে খুব সুন্দর মানিয়েছে জামাইকে।

প্রাণতোষ হাসলো। লক্ষ্মী দিদি বলল, সাঁঝ হয়ে এল দিদিমণি। এবার যে আমাকে ঘরে ফিরতে হবে।

রমলা বলল, হ্যাঁ, দিদি তোমাকে আর আটকাবো না। রমলা লক্ষ্মীদিদিকে নিয়ে একতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

যাবার সময় লক্ষী দিদি রমলার  গালে হাত দিয়ে বলল,এখন ঘর বেঁধেছো বোন। মন পাখিকে পোষ মানাও। নাহলে যন্ত্রণা বাড়বে।

লক্ষ্মী দিদি কথাগুলো কেন বলল, রমলা বুঝতে পারল না। রমলা কিছু বলার আগেই লক্ষ্মী দিদি হন হন করে হাটা দিল। মায়ের মন্দিরের থেকে তখন সন্ধ্যা আরতির ঘন্টা ভেসে আসছে।

রমলা পেছনে ঘুরে দেখল প্রাণতোষ এসে দাঁড়িয়েছে। রমলা বলল, চলো মায়ের মন্দিরে প্রণাম করে আসি। প্রাণতোষ বলল, তাই চলো।

দ্বিরাগমন সেরে রমলা আর প্রাণতোষ কলকাতায় ফিরল৷ কলকাতায় ফিরে প্রাণতোষ ব্যস্ত হয়ে পরল। দিল্লি যাবে ,ব্যবসার কারণে। তাই ফাইল পত্তর সব গোছাতে শুরু করল৷ প্রাণতোষ সকালে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে রোজই রাত হয়৷ রমলা শাশুড়ির সঙ্গে টুকটাক কাজকর্ম করে৷ কিন্তু সে আর কতক্ষণ? তারপর বড় ফাঁকা লাগে। যখন থেকে রমলা এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে তখন থেকেই দেখেছে ছবি মাসি মুখ বুঝে কাজ করে৷ খুব কম কথা বলে৷ ছবি মাসিকে রমলার শাশুড়ি খুব বিশ্বাস করে। রমলার বাপের বাড়িতে যে পারিবারিক বাঁধনটা ছিল এই বাড়িতে সেটা নেই। এখানে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। শ্বশুরমশাই আর প্রাণতোষ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জলখাবার সেরে ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যান। শাশুড়ি মা সারাদিন ঠাকুর ঘরে গোপাল সেবা নিয়ে থাকে। ছবি মাসি সংসারের সব কাজকর্ম করে। রমলার একমাত্র কোনও ব্যস্ততা নেই। রমলার ভেতরটা ডুকরে ওঠে৷ ভোরবেলা না হলেও রোজ সন্ধে বেলা রমলা বাড়ির পেছনের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময় ব্রজেস্বর বারান্দায় বসে। প্রকৃতির ব্যস্ততা দেখে। দেখে পাখিদের গাছগাছালি সংসারের জন্য ঘরে ফেরা। ব্রজেশ্বরের বিষয় জানতে রমলার মন চায়। কিন্তু কাকেই বা সে জিজ্ঞাসা করবে। সেদিন ছবি মাসি বাড়িতে মালপোয়া আর তালের বড়া করল। রমলাকে চিনামাটির রেকাবিতে করে মালপোয়া আর তালের বড়া বাড়ির অন্য কাজের লোক মন্দা দিয়ে গেল। রমলা হাতে রেকাবিটা  নিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াতে দেখল, ছবি মাসি ঢাকা বাটি করে ব্রজেস্বরের কাছে এসেছে। ব্রজেশ্বর ছবি মাসিকে দেখে এক গাল হাসলো। তারপর ছবি মাসির হাত থেকে বাটিটা নিয়ে তালের বড়া আর মালপোয়া খেতে লাগলো। ব্রজেস্বরের প্রতি ছবি মাসির আচরণ রমলাকে বুঝিয়ে দিল এই বাড়িতে ছবি মাসির পরম স্নেহের জায়গা ব্রজেশ্বর ৷

এখন প্রাণতোষের ফিরতে রোজই দেরী হয় রমলা সেটা জানে।  রান্নাঘর ডাইনিং পেরিয়ে ছবি মাসির শোবার ঘর ৷ তালের বড়া আর মালপোয়া খেয়ে রমলা ছবি মাসির ঘরের দিকে গেল। দরজায় রমলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছবি মাসি একটু অবাকই হল। তারপর বলল, নতুন বউ তুমি এখানে কি করছ?

— মাসি সারাদিন একা থাকি।  তোমাকে দেখি সারাদিন মুখ বুজে কাজ করে যাও। আমারও কথা বলার কেউ নেই। তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগে। শাশুড়ি মা  সারাদিন তার পুজোপাঠ ঠাকুর ঘর নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই ভাবলাম তুমি  তো আর আমার কাছে আসবে  না। আমি বরং যাই তোমার  কাছে।

ছবি মাসি আর কোনও কথা বলতে পারল না। হেসে ফেলল। বলল ,এসো এসো মা আমার ঘরে।

ছিমছাম ঘর। ঘরের মধ্যে একটা কাঠের চৌকির ওপর বিছানা পাতা। একটা আলনা তাতে ছবি মাসির শাড়ি ভাঁজ করে রাখা। আর কাঠের একটা আলমারি। আলমারির পাল্লায় একটা আয়না লাগানো। দরজার উপরে একটা তারা মায়ের ছবি। রমলা ঘরে ঢুকলে পরে ছবি মাসি তাকে নিয়ে চৌকির উপরে বসাল। ছবি মাসি পরম স্নেহে বলল, দোতালার ঘরে একা একা থাকতে ভালো লাগে না বুঝি।

রমলা মাথা নাড়ল৷  তারপর জিজ্ঞাসা করল, মাসি তোমার বাড়ি কোথায়?

— নবদ্বীপে তোমার শ্বাশুড়ীর আদি বাপের বাড়ি যেখানে ,তার পাশেই। পরে তো তোমার শাশুড়ির বাবা মানে তোমার দাদা শ্বশুর  উকিল হয়ে কলকাতায় বাড়ি করল। কিন্তু তার বাবা,মা অন‍্য ভাই বোন আত্মীয় পরিজনেরা নবদ্বীপেই থেকে গেলেন।

—তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

মাসি হেসে ফেললো। তারপর বলল ,দুই দাদা আছে তারা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখে না। খুব ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়েছি। তারপর আমার জেঠামশাই আমাকে দোজ বরে বিয়ে দিলেন। স্বামীর আগের পক্ষের ছেলে মেয়েরা সব বড় বড়। কিছুদিন পর স্বামীও যক্ষা হয়ে মারা গেল। তখন সতীনের ছেলেমেয়েরা আমাকে তাড়িয়ে দিলো। বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলাম।

বাপের বাড়িতে তখন আমি বোঝা। দাদাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের বউরা আমাকে সহ্য করতে পারে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতাম। তবুও তাদের মন পেতাম না। তোমার শাশুড়ি আমার ছেলেবেলার সই ছিল। আর তোমার জেঠি শাশুড়ি বড় বাড়ির মেয়ে ছিল। সে তখনকার সময় খুব ভালো সেলাই জানতো। আমি তার কাছে গিয়ে সেলাই শিখেছিলাম। তোমার জেঠি শাশুড়ি আর তোমার শাশুড়ি দুজনেই নবদ্বীপের মেয়ে। বিয়ের আগে থেকেই তারা দুজন দুজনকে চিনত৷ তোমার জেঠি শাশুড়ি বাচ্চা হতে গিয়ে বাপের বাড়িতে যান। তারপর ছেলে প্রসব করে সুতিকা রোগে মারা যায়। আমাকে বলে গিয়েছিল ছবি আমার ছেলেটাকে দেখিস। ওই এক রত্তি ছেলেটা আমার হাতেই মানুষ। তারপর তোমার জ্যেঠা শ্বশুর স্ত্রীর মুখাগ্নি করে ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। সঙ্গে আমাকেও নিয়ে এলেন। বললেন ,বড় বউ যখন তোমার উপর আমার ছেলের দায়িত্ব দিয়ে গেছে তখন তুমিও চলো কলকাতায় ৷ আমি বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারিনি। আমিও দাদাদের বলে জামা কাপড় গুছিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। আমার দাদা বৌদিরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আমার সই মানে তোমার শাশুড়ি আমাকে পেয়ে খুব নিশ্চিন্ত হল। ব্রজ মানে তোমার ভাসুরের যখন চার বছর বয়স তখন  প্রাণতোষ হল। আমি তখন একটা না দু-দুটো বাচ্চাকে লালন পালন করতে লাগলাম। ব্রজ যখন দশ বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা গেল। ছেলেটা একেবারে অভিভাবকহীন হয়ে গেল। জন্মের পর থেকে যেহেতু আমাকে দেখছে তাই আমাকে খুব ভালোবাসে। ওর কাকা, কাকিমাকেও খুব ভালোবাসে। ছোট ভাই প্রাণতোষকেও খুব স্নেহ করে। কিন্তু ও গান পাগল মানুষ। সারাদিন গান বাঁধে। কারও সঙ্গে মিশতে চায়না। বড় বাড়িতে  ও আসে না। বাড়ির পেছন দিকটায় থাকে। আমি রোজ সন্ধের পর ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসি৷

তুমিও তো শুনেছি ভালো গান করো মা।

রমলা বলল ,ওই একটু আধটু সেরকম কিছু না।

—আমি তোমার কথা ওকে বলেছি জানো তো। ও শুনে বলেছে খুব ভালো। সকলেরই ও ভালো চায়। কিন্তু ওকে কেউ বোঝেনা।

কথাগুলো বলে ছবি মাসি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বলল, চলো মা রাত হয়ে গেছে। এখন নিজের ঘরে যাও। আমিও রান্নাঘরের দিকে যাই। রাতের খাবার আয়োজন করতে হবে।

রমলা দোতলা ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ছবি মাসিও তার ঘরের দরজাটা বাইরে দিক দিয়ে টেনে তুলে রান্নাঘরে গেল।

রমলা তার ঘরে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর ঘরটাকে অন্ধকার করে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। এখান থেকে ব্রজেশ্বরের ঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়। রমলা দেখতে পেল ব্রজেস্বর একতারা হাতে চোখ বুজে বসে রয়েছে। মাঝে মাঝে চোখ খুলছে। আর খাতায় লিখছে৷

রমলার মনটা ছটফট করতে লাগলো। মনে মনে ভাবল ,যদি একটু আলাপ করা যেত। কিন্তু এই বাড়িতে কার কাছে সে এই কথা বলবে। সে নতুন বউ। তার এই কথা শুনলে কেউ ভালোভাবে নেবে না। ছবি মাসিতো ওর কথা ওনাকে বলেছে। শুনে উনি খুশি হয়েছেন। আচ্ছা, ছবি মাসিকে বললে কেমন হয়? রমলা এটুকু বুঝেছে এই বাড়ির কেউই ওনাকে পছন্দ করেনা। আর উনিও পছন্দ করেন না ওনার কাছে কেউ আসুক।  দেখা যাক কি হয়?

তারপর রমলা খাটের উপর এসে শুয়ে পড়ল। চোখটা বুজল৷ কানে ভেসে এলো ,

রাধে যতন করে বাঁধিস চুল,

খোঁপায় দিস কদম ফুল।

তোর মনোহরণ বাজায় বাঁশি,

আজও বৃন্দাবনের নিধিবনে৷

 

চলবে…

কৃষ্ণা গুহ রয়- উপন্যাসিক, কবি। পশ্চিমবঙ্গ


অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে হলে

পর্ব -১  পর্ব -২  পর্ব -৩   পর্ব -৪  পর্ব – ৫  পর্ব – ৬   পর্ব – ৭  পর্ব – ৮  পর্ব – ৯  পর্ব – ১০  পর্ব – ১১   পর্ব-১২

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন