প্রবাসের সংবাদ ফিচার্ড

ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রমবাজার

ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রমবাজার

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের শ্রমবাজার। গত ডিসেম্বরে রেকর্ড জনশক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে গেল বছরে মোট ছয় লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ডিসেম্বর মাসে কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যান এক লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন কর্মী। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক মাসে এত বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়নি।

এর আগে ২০১৭ সালের মার্চে এক লাখের কিছু বেশি কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। মহামারির কারণে ২০২০ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নামে। সে বছর মাত্র দুই লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু মহামারির আগের বছর (২০১৯ সালে) বিদেশে যান সাত লাখ ১৫৯ জন কর্মী। সারা বিশ্বে লকডাউন স্বাভাবিক হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালে ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখতে শুরু করে শ্রমবাজার। বছরজুড়েই চাঙা ছিল শ্রমবাজার। ফলে বর্তমানে তা মহামারির আগের পর্যায়ে ফিরেছে।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, নতুন করে শ্রমবাজার না খুললেও পুরোনো বাজার থেকেই চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া খুলতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও। ইতোমধ্যে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন বছরে জনশক্তি রপ্তানি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ।

এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শিগগিরই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। এবার সম্পূর্ণ সিন্ডিকেটমুক্ত রেখে কম অভিবাসন খরচে কর্মী পাঠানোর চেষ্টা করব। এবার বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করা হবে। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।

জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রধান বাজার মধ্যপাচ্যের দেশগুলো। দুই বছরের মহামারির ধাক্কা সামলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো এই দেশগুলোও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাঙা হচ্ছে এসব দেশের অর্থনীতি। সব মিলিয়ে তাদের কাজের লোকের চাহিদা বেড়েছে। তাই বাড়ছে জনশক্তি রপ্তানি। এ কারণে আগামী দিনগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা আমার সংবাদকে বলেন, ‘২০২০ সালে করোনা বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছিল। যার ফলে বিদেশে বিভিন্ন প্রজেক্ট স্থগিত হয়ে যায়, ফান্ডিং হচ্ছিল না। এসব কারণে ভিসা যেমন কম ছিল, একই সাথে অনিশ্চয়তার কারণে কেউ বিদেশে যেতেও চাইত না।

২০২১ সালে করোনার আতঙ্ক অনেকটা কেটে গেছে। এটা এখন সাধারণ ফ্লুর মতো, ঝুঁকিও আগের চেয়ে অনেক কম। তাই সবার মাঝে আস্থা ফিরে এসেছে। এর ফলে জনশক্তি রপ্তানির ফ্লু বেড়েছে। ২০২২ সালে এটি আরো বাড়বে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি প্রবাহও বাড়বে।’ ডিসেম্বরে রেকর্ড সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানিতে সংশ্লিষ্টদের কনফিডেন্স কাজ করেছে বলে মনে করেন বায়রার সাবেক এই সভাপতি।

তিনি বলেন, ‘সময়ের সাথে এমপ্ল্লয়ার, এমপ্লয়ি, অর্থনীতিবিদ, সরকার ও রাজনীতিবিদ সবাই কনফিডেন্স ফিরে পেয়েছে। একই সাথে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। এর একটা প্রভাব জনশক্তি রপ্তানিতে পড়েছে। এছাড়া তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। সব মিলিয়ে নতুন বছরে শ্রমবাজার আরো চাঙা হবে।

বিএমইটির তথ্যে দেখা যায়, গত বছর যে সোয়া ছয় লাখের মতো কর্মী বিদেশে গেছেন, তাদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে গেছেন ৩৫ হাজার ২৩২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৯ হাজার ৫১০ জন এবং মার্চে ৬১ হাজার ৬৫৩ জন। এপ্রিলে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর গতি কমে যায়। ওই মাসে ৩৪ হাজার ১৪৫ জন কর্মী গেছেন। মে মাসে গেছেন ১৪ হাজার ২০০ জন।

জুন মাসে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসতে থাকলে আবার সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুনে গেছেন ৪৮ হাজার ৫৬৭ জন, জুলাই মাসে ১২ হাজার ৩৮০ জন, আগস্টে ১৯ হাজার ৬০৪ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৪২ হাজার আটজন গেছেন। অক্টোবরে ৬৫ হাজার ২৩৩ জন, নভেম্বরে এক লাখ দুই হাজার ৮৬১ জন এবং ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন এক লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন।

২০২১ সালে মোট জনশক্তি রপ্তানির মধ্যে চার লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন বা ৭৪ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন ২৯ হাজার ২০২ জন, কুয়েতে এক হাজার ৮৪৮ জন, ওমানে ৫৫ হাজার ৯ জন, কাতারে ১১ হাজার ১৫৮ জন, বাহরাইনে মাত্র ১১ জন, লেবাননে ২৩৫ জন, জর্ডানে ১৩ হাজার ১১৬ জন, লিবিয়ায় তিনজন, সুদানে ৩৯ জন, মালয়েশিয়ায় ২৮ জন, সিঙ্গাপুরে ২৭ হাজার ৮৭৫ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৮ জন, ইউকেতে ১২৩ জন, ইতালিতে ৬৫৩ জন, জাপানে তিনজন, ব্রুনাইয়ে ১২ জন, মরিশাসে ২১৫ জন এবং ইরাকে গেছেন পাঁচজন। এদিকে নারী জনশক্তি রপ্তানিও আগের বছরগুলোর চেয়ে বেড়েছে। ২০২১ সালে ৮০ হাজার ১৪৩ জন নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন।

জানুয়ারিতে গেছেন চার হাজার ৬৬৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ছয় হাজার ৩৮২ জন, মার্চে আট হাজার ২৯৭ জন, এপ্রিলে পাঁচ হাজার ২৩৯ জন, মে মাসে চার হাজার ২৩৮ জন। জুনে ছয় হাজার ৯০১ জন, জুলাইয়ে এক হাজার ৬৯১ জন, আগস্টে তিন হাজার ৬৫৯ জন, সেপ্টেম্বরে আট হাজার ৫৩ জন, অক্টোবরে আট হাজার ৪৮৮ জন এবং নভেম্বরে ১০ হাজার ৯৬২ জন নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। সর্ব শেষ ডিসেম্বরে গেছেন সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৫৬৪ জন।

নারী কর্মীদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে গেছেন ৪৬ হাজার ৩৬১ জন। এর পরে জর্ডানে ১১ হাজার ৬৯৭ জন, আর ওমানে গেছেন সাত হাজার ৬৪৫ জন নারী কর্মী। গত বছর এই তিন দেশেই সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী পাঠানো গেছে। বিএমইটির রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট এক কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজে গেছেন।

এই বিপুল সংখ্যক জনশক্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।  বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, গত বছর যে সংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছেন, তাদের ৭৪ শতাংশই অদক্ষ। আর ৩ দশমিক ৬ শতাংশ আধাদক্ষ। আর দক্ষ কর্মীর সংখ্যা ছিল ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ফের গতি ফিরছে। টানা পাঁচ মাস কমার পর ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই গতি আরও বেড়েছে। জানুয়ারিতে দেশে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১.৭০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ ১৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা আগের মাস ডিসেম্বরের চেয়ে ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। গত বছরের একই মাসের (২০২১ সালের জানুয়ারি) তুলনায় এবার রেমিট্যান্স কমেছে দুই হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। -আমার সংবাদ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন