লেখালেখি

মননে সুন্দর মানুষ

মননে সুন্দর মানুষ

ক্যালেন্ডারের প্রতিটি দিনিইতো এখন উইকেন্ডের মতো। পুর্ণ অবকাশ। শুয়ে,বসে, দাঁড়িয়ে, সেকেন্ড-মিনিট ঘন্টার মন খারাপের সময়ের সাথে সয়ে যাওয়া। আজ সকালে বে-উয়িন্ডোর পর্দা ঠেলে দিতেই আদর কেড়ে নিলো ঝলমলানি রোদ। রাস্তার ওপারে একটি গাছের শূন্যের দিকে এলোমেলো মেলে ধরা কিছু কাঠির কঙ্কালের ফাঁক দিয়ে জীবনের রোদ এসে পড়ছে লিভিং রুমে। আলোর রেনু রাঙিয়ে নিলো মন। অনুমতি না নিয়ে ঈশ্বরের মতো যিনি যখন তখন ঢুকে পড়েন আমাদের হৃদয়ে, সেই তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন “আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াবো গাহিয়া আকুল পাগল পারা” কিন্তু উপায় কি? নিয়ম বাঁধার জীবন এখন নিয়ম মানায় বন্দি। কাঁচের ভিতর থেকে বাইরের আকাশের মায়াবী স্পর্শ নেয়া। সামারের পুরো সময়টা দুটো স্ক্রুরেল রেলিঙের উপর খেলা করে, এর আগের প্রতিটা বছর এদের এমন করেই দেখেছি। পর্চের ঠিক ডান দিকে আমারই লাগানো একটা গাছ, শীতের বৈরাগ্য সরিয়ে গজিয়েছে হলুদ পাতা ; নাম জানিনে, তবে খুব সুন্দর। অথচ এদের কে কখনোই আমার প্রতিবেশী মনে হয়নি এর আগে। লক ডাউনের জীবনে এরা আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছ।

প্রতি মুহুর্তের চেনা গন্ধের দাবীদার সে কফি রেখে যায় কর্নার টেবিলে, চুমুক দিতে দিতে ফেইসবুক স্ক্রল করছি কে যেনো কবিতা আপলোড করেছে “এই যাত্রায় বেঁচে গেলে ভীষণ রকম বাঁচবো” আহা কি কন্ঠের দ্যোতনা। এখন কবিরা ও ঈশ্বরকে গিভ এন্ড টেইকের লেসন দিচ্ছেন। আমাকে বাঁচিয়ে দাও পরে নিজেকে মানবিক করে তুলবো। অনেকটা দরগায় মানত করার মতো। রোদের তাপে নিজেকে একটু আড়াল করতে হলো। পৃথিবীর কপালে থার্মোমিটার দিলে দেখা যাবে জ্বর এখনও অনেকটা, নিঃশ্বাসের বিষ তীব্র। তবু বেঁচে আছি, বেঁচে আছি আলোর দিশার ঝলকানিতে, চাঁদ আর জোৎস্নার মিতালিতে, চির স্বাদের ওষ্ঠের অভিঘাতে। বাঁচতে হবে, নিজের মতো করে বাড়তে হবে, সম্ভাবনাময় পরিচয় রাখতে মধুময় ক্ষণের কাছে,  সুন্দর আগামী অপেক্ষা করে আছে সবার জন্য।

প্রশ্ন জাগতেই পারে আশেপাশে সবইতো সুন্দর আর বাকি রইলো কি? সমাজে,নমাজে অনেকেই অঙ্গে সুন্দর কিন্তু মন অপরিস্কার।  আবার চেনা -অচেনা, কাছের -দুরের অনেক বন্ধুবৃত্তে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই যারা মননে সুন্দর। ঠিক আজ সকালেই দেখা হলো মধ্য বয়স্ক এক ইস্ট ইউরোপিয়ান যে আমার প্রতিবেশীর ঘাস কেটে দেয়।  প্রতি বছর এই সময়টা থেকেই সে কাজ শুরু করে। আসা যাওয়ার পথে ইষৎ হাসি বিনিময়ের পরিচয়। যথারীতি আজও সে প্রতিবেশীর ঘাস কেটে দিচ্ছিলো সম্ভবত আজই সিজানের প্রথম। কিছুক্ষণ পর নক-নক শুনে দরজা খুলে দেখি সেই মানুষটি; আজ নামে চিনলাম মিঃডেভিড। সাথে ঘাস কাটা এবং ট্রিম করার যন্ত্র নিচে রাখা। জানালো অনুমতি দিলে সে বে- উইন্ডোর সামনের অংশে, সদ্য গজানো ঘাস ট্রিম করতে চায়। বললাম আমারতো মেশিন আছে আর ঘাস তেমন বেড়ে উঠেনি যে এখনি কাটতে হবে। সে কাচুমাচু হয়ে বললে, প্রতিবেশীর জায়গাটুকু ট্রিম করে সে ২০ ডলার পেয়েছে, আমার জায়গা এতটা বড় না, তাই ১০ ডলার হলেই চলবে, এবং এই টাকা নিয়ে সে গ্রোসারি করবে। না আমি তাকে সি,আর,বি নিয়ে কোন জ্ঞান দিতে চাইনি কারণ তাঁর সরল স্বিকারোক্তিতে মনে হয়েছে সে একটি সুন্দর মনের মানুষ।

মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছিল এক অজানা ভয় ঘিরে আছে তাকেও। তবু ডেভিড কাজ সেরে ডলার হাতে নিয়ে, রোগমুক্ত ঝলমলে ধরিত্রীর প্রার্থনা করে বিদায় নিলো। নিয়ম মানার জীবনের এখন প্রধানতম রুটিন হলো খানা আর ঘুম। খানিকটা সময় বেড়ানো স্ক্রিন থেকে স্ক্রিনে এই চ্যেনেল থেকে সেই চ্যেনেল; মৃত্যুর পরিসংখ্যানে ভরা জীবন।

“আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুনানি,

সমানি চৈতাদি নৃনাঃ পশুনাম

জ্ঞানী নরানামাধিকো বিশেষ্য”।

আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন মানুষ এবং পশুর মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান। মানুষ জ্ঞানী এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা।

মানুষ চিন্তা করতে পারে, পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে, বন্ধুর হাত বাড়াতে পারে।

চ্যানেলে চ্যেনেলে এত ইনফরমেশন, এটেনশান পেলো যমুনা নিউজের একটি সংবাদ। ঝিনাইগাতি, শেরপুরের এক ভিক্ষুক তাঁর জমানো দশ হাজার টাকা দান করেছেন করোনা চিকিৎসা ত্রান তহবিলে।

গীতা বলে যখন ধর্মের গ্লানি হয়, অধর্ম বেড়ে যায়, সাধুদের পরিত্রাণ আর দুস্কৃতিকারীর বিনাশে ভগবান অবতার হন। অবশ্য দেখা হয়নি এখনো। কিন্তু ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন সে নগরলক্ষ্মী বিষ্ণুপ্রিয়ার অবতার। রবীন্দ্রনাথের কথা ও কবিতা কাব্যে নগরলক্ষ্মী কবিতায় বুদ্ধের শ্রাবস্থিপুর গ্রামে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে, তিনি তাঁর সভার সকলকে প্রজাদের অন্নের জোগারের আদেশ দেন। উপস্থিত সবাই কোন না কোন অজুহাতে তা এড়িয়ে যান।  সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধের পরম ভক্ত অনাথপিন্ডদের কন্যা ভিক্ষুণী বিষ্ণুপ্রিয়া।  কবির রচনে

“তখন উঠিল ধীরে ধীরে

রক্তভাল রাজনম্রশিরে

অনাথপিণ্ডদসুতা                   বেদনায় অশ্রুপ্লুতা,

বুদ্ধের চরণরেণু লয়ে

মধু কণ্ঠে কহিল বিনয়ে–

ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়া

তব আজ্ঞা লইল বহিয়া।

কাঁদে যারা খাদ্যহারা              আমার সন্তান তারা,

নগরীরে অন্ন বিলাবার

আমি আজি লইলাম ভার।’

বিশ্ময়ে সবাই তাকে বললে ভিক্ষুণী তুমি কোন অহংকারে এই গুরুকাজ মাথায় পেতে নিলে। সে সকলকে প্রণাম করে বললে আমার শুধু এই ভিক্ষার পাত্র আছে। তোমরা সকলে দয়া করলে বিজয়ী হবোই।

“আমার ভাণ্ডার আছে ভরে

তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।

তোমরা চাহিলে সবে ,এ পাত্র অক্ষয় হবে।

ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা–

মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’

 

নাজিম উদ্দিন বুদ্ধ ভক্ত বিষ্ণুপ্রিয়ার এই ঘোর পাপ কলির পুরুষ অবতার। মানবতা যখন দেখানোপনা আর বিজ্ঞাপনে ঢাকা, আমাদের সমাজের গালে চপেটাঘাত করে অকালে বিজয়ার বাদ্য বাজালেন নাজিম উদ্দিন সময়ের সবচেয়ে সুন্দর মানুষ।

ছোটবেলায় হাটবারে যখন দোকানে বসতাম, হাট ভাঙ্গা বিকেলে এক অন্ধ ভিখারি আসতো হাঁক দিতে দিতে বাবার কাছে  “ও কাকা আমার খুছরা গইন্না দেওরে বা”  আমার বাবা পরম যত্নে তা গুনে দিতেন। কচি বয়সে বিশ্ময়ের অন্ত ছিলো না, যে বাবার আমার অংক, বিজ্ঞান দেখার সময় ছিলোনা অথচ এই ভিক্ষুককে ব্যাস্ততার অজুহাতে ফিরিয়ে দেননি কখনও। কি জানি বাবা হয়তো ঐ ভিক্ষুকের মাঝে কোন সুন্দর খুঁজে পেয়েছিলেন। বাবার চোখের বাইরে যেয়ে এবার নাজিম উদ্দিন আপনার মাঝে সেই মননের সুন্দরটুকু দেখলাম। আপনি মননে সবচেয়ে সুন্দর মানুষ।

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব। টরোন্ট। কবি ও লেখক

২২/০৪/২০

 

সিবিএনএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন