দেশের সংবাদ ফিচার্ড

যুক্তরাষ্ট্রের হাই পাওয়ার টিম ঢাকা আসছে : চালাবে সমঝোতার চেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্রের-হাই-পাওয়ার-টিম

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে শিগগিরই ঢাকা সফরে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, অর্থনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। উদ্ভূত সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ উল্লেখযোগ্য দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাবে এ চৌকশ টিম। সফরটি শুরু হবে ১০ জুলাই থেকে এবং ১৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।

এদিকে মার্কিন এ প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে জনমনে নানা কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তবে অনেকের আগ্রহ ঘুরপাক খাচ্ছে ডোনাল্ড লুকে ঘিরে। কারণ, পাকিস্তানে ইমরান খান সরকারকে অপসারণে ডোনাল্ড লুর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সরকারকে হটানোর জন্য দেশটির ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরাসরি ডুনাল্ড লুকে দায়ী করেন।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র ২৪ মে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এরপর থেকে নতুন মাত্রায় রাজনীতির মাঠ সরগরম হতে শুরু করে। বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ নানা ইস্যুতে প্রশ্ন তুলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস এবং ১২ জন কংগ্রেসম্যান কড়া চিঠি ও বিবৃতি দিয়েছে। বিপরীতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করা হয়। এর ফলে পররাষ্ট্র নীতির আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে একধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের সফর চূড়ান্ত হওয়ায় নানামুখী গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অব্যাহতভাবে যুক্ত আছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বহুবিধ সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব বিষয় আলোচনা করার জন্য তারা এবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন।’

সূত্র জানায়, মার্কিন প্রতিনিধিদলের এবারের সফরের এজেন্ডায় মূলত নির্বাচন, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। এ কারণেই সমঝোতার চেষ্টা চালাবে। রাজনীতি ও নির্বাচনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট এবং শ্রম অধিকারও গুরুত্ব পাবে এ আলোচনায়। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিদেশি হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। ফলে এর মধ্যে কীভাবে আলোচনা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, এই রাজনৈতিক সমঝোতার নামে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের সফর পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর প্রবল স্নায়ুচাপ তৈরি করবে। বিশেষত, অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সমঝোতা উদ্যোগের এই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। মূলত সংকট নিরসনে এ আলোচনা উদ্যোগটি ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ ও উদ্দেশ্য হাসিল করতে এভাবে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত রাখবে। দৃশ্যত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় তেমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে বাইডেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা একের পর এক বাংলাদেশ সফর করছেন। চলতি মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও আসছে প্রাক-নির্বাচনি পর্যালোচনা মিশন। জাতিসংঘ থেকেও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা আসছেন।

মার্কিন প্রতিনিধিদলটি দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সংলাপের বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু যুগান্তরকে বলেন, ‘আসুক, বুঝি, আগেই কীভাবে মন্তব্য করব।’

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের অবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল সরকারের ভেতরে ও বাইরের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।’

জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিনিধিরা আসছেন। তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য। ভিসানীতি, কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতি-এসবই নির্বাচনকে ঘিরে করা হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, মানুষের ভোট দেওয়ার জন্য যে যাই করুক, আমরা তার সঙ্গে আছি।’ সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার আহ্বান জানালে বিএনপি অংশ নেবে কি না জানতে চাইলে রুমিন ফারহানা বলেন, ‘সরকার পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে।’

রাজনৈতিক সংকটে বিদেশিদের যত মধ্যস্থতা : বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটে বিদেশিদের মধ্যস্থতা নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এমন তৎপরতা দেখা গেছে। তবে বিদেশি মধ্যস্থতা কার্যত প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বিদেশি চাপে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সংলাপ থেকেও তেমন ফল আসেনি। ভিন্ন উদ্দেশ্যে মোড়ানো এসব সংলাপে আন্তরিকতার অভাব ছিল লক্ষণীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংলাপ ছিল লোক দেখানো।

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন স্যার নিনিয়ান স্টেফান। ওই বছর মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। এরপর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জোরালো দাবি আনে আওয়ামী লীগ। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলাটি ছিল জামায়াতের। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকারকে হটাতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। হরতাল-সহিংসতায় দেশের পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৭৩ দিন হরতাল পালনসহ তীব্রতর আন্দোলনের একপর্যায়ে বিদেশিরা সালিশদারের ভূমিকা পালন করতে আসেন। দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে উদ্যোগ নেয় কমনওয়েলথ। স্যার নিনিয়ান স্টেফানকে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসাবে ঢাকায় পাঠানো হয়।

নিনিয়ান ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। একপর্যায়ে তিনি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ-সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়াও একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর প্রস্তাব করেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই ফর্মুলা মানেনি। স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছিল আওয়ামী লীগ। সমঝোতা না হওয়ায় ফিরে যান স্টেফান। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য সেই নির্বাচনের পর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

এছাড়া রাজনৈতিক সংকটের মুখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বহুল আলোচিত সংলাপ হয় ২০০৬ সালের অক্টোবরে। তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের তরফে দুটি দাবিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। এ দুই দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে বিচারপতি কেএম হাসানের নাম না থাকা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে এমএ আজিজের পদত্যাগ।

আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার পদ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বিচারপতি কেএম হাসান। ফলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে বিরোধী রাজনৈতিক জোট নির্বাচন থেকে সরে যায়। রাজপথে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চরম আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে আলোচিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতা হাতে নেয়। সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকার টানা দুই বছর দেশ পরিচালনা করে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে। এর প্রতিবাদে বিএনপি রাজপথে নানাভাবে আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষদিকে বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জনসহ টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু এ কর্মসূচির নামে যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথমদিকে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেস তারানকো। শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান রেখেই একটি নির্বাচনি ফর্মুলা বের করার চেষ্টা করেছিলেন আর্জেন্টিনার এই কূটনীতিক। কিন্তু বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। তারানকো ঢাকায় রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন।

সূত্র : যুগান্তর

CBNA24 অনলাইন ডেস্ক (এফএইচ/বিডি)

আমাদের ফেসবুক পেজে যেতে ক্লিক করুন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে যেতে ক্লিক করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন