ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

দেখো আলোয় আলো আকাশ | ছোট গল্প ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

ছবি ইন্টারনেট থেকে, আংশিক ডিজাইনঃ সদেরা সুজন

দেখো আলোয় আলো আকাশ | ছোট গল্প ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

ডাক্তার, রোগীর অবস্থা আরো খারাপের দিকে, অক্সিজেন লেভেল দ্রুত কমে যাচ্ছে। ওকে দেখুন, তাড়াতাড়ি দেখুন ডাক্তার। দূরদূরান্ত হতে ভেসে আসা এক ক্ষীণ আর্তনাদ বাতাসে ভাসতে ভাসতে অমিতের কানে পৌঁছে। অমিত তাকাতে চায়, কিন্তু মাংসপেশি তার সাথ দিতে চায় না। প্রগাঢ় ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে ও চেষ্টা করে যায়। ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে সরসীর জলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা অস্পষ্ট খানিক চেনা, খানিক অচেনা নার্স মারিয়ার মুখচ্ছবি। চারিদিকে আলো আধারের এক নীরব জগত। অমিত সেই নৈঃশব্দের মাঝে শুনতে পায় কিছু চিৎকার, কিছু কান্না, কিছু অবোধ্য কথামালা। অমিত ভেবে পায়না সে কোথায়। ও শরীর থেকে বিমুক্ত হয়ে আস্তে আস্তে উঠে যেতে থাকে ঊর্ধ্ব পানে। ঘরের সিলিঙয়ে বাধা পেয়ে ঝুলে থাকে ক্ষণকাল। ও দেখতে পায় বেডের পর শুয়ে থাকা নীল হয়ে যাওয়া বেদনাহত ওর শরীর- যে শরীর সহ্য করেছে কতো দুঃসহ যন্ত্রনা। প্রতিটি নিঃশ্বাস ছিল ওর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। ওর পাঁজরের মাঝে কে যেন বিছিয়ে রেখেছে কন্টকাসন। অমিত সেই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে বাস্তব ও পরাবাস্তব জগতের মাঝামাঝি ঝুলে থাকে। মায়া মমতার জগত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অমিত এ জগত ছেড়ে চলে চায় না যেতে। ও যে মাতৃসমা নার্সটিকে নিজের মার মতো ভালবেসে ফেলেছে! অমিত ভাল হয়ে গেলে মারিয়া ওকে মেক্সিকোর পাহাড় ঘেরা গ্রামের বাড়ী নিয়ে যাবে, মারিয়া নিজ হাতে ওকে তামেলা বানিয়ে খাওয়াবে। অমিত ছলছল চোখে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মারিয়া ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওর মুখে কি যেন পড়িয়ে দেয়। ডাক্তার বিষণ্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে ।

এ অল্প ক’দিনে অমিত মারিয়াকে ভালবাসার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। প্রকৃতি অমিতকে অকুণ্ঠ হাতে দান করেছে মায়া মমতা, স্নেহ ভালবাসার অপার সম্পদ। পরকে আপন করার কি অফুরন্ত শক্তি ওর। মানুষের বিপদে ও অনায়াসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছু না ভেবেই। এ সংক্ষিপ্ত জীবনে ক্ষণিক আলাপে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছে কতো দেশ মহাদেশের প্রাণকে। প্রায় এক দশক আগে অমিত পাড়ি জমিয়েছিল আমেরিকার পথে। তার এ জীবনের পথ ছিল বড় বেশী বন্ধুর। দালালের হাত ধরে মধ্যবিত্ত পরিবারে অকালে হারিয়ে যাওয়া পিতার স্থান নিতে মেক্সিকোর বিপদসংকুল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ও আস্থানা গেড়েছিল নিউ ইয়র্কে। ওখানেই তার নিবির বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এক ঘন কালো কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের সাথে। ওরা একসাথে কাজ করতো এক মিট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে। কাজ করতে করতে টাইসন কতো কথা বলতো ওর সাথে। কথা হতো ওর পুর্বপুরুষের দাসত্বের জীবন নিয়ে, কথা হতো জ্যাক্সন হাইটের কলোনিতে বর্ণ বৈষম্যের মাঝে বড় হয়ে ওঠা জীবনের নানা দিক নিয়ে। একদিন কাজ করতে করতে টাইসন ঝুঁকে পড়ে কনভেয়ার বেল্টের পর। ওর শরীরে কোন শক্তি নেই। চোখগুলো বিস্ফোরিত করে ও হাঁপাতে থাকে। অমিত তার কোলের পর টাইসনের মাথাটি রেখে মুখ দিয়ে শ্বাস দিয়ে চলে। বেশ কিছুদিন ধরে ও যে জ্বরে আক্রান্ত ছিল, ওর শরীরে যে করোনা বাসা বেধেছে তা সে বুঝতে পারেনি। এম্বুলেন্স আসে, আপাদ মস্তক মহাশূন্যচারির মতো আপ্রন পড়ে স্বাস্থ্য কর্মীরা টাইসনকে উঠিয়ে নিয়ে যায় সাইরেন বাজিয়ে। হাসপাতালে অমিত টাইসনের পরিবারের পাশে দাড়ায়। টাইসন ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। টাইসনের অবর্তমানে সে তার নিজ কাঁধে তুলে নেয় ওর বৃদ্ধ পিতামাতার দেখভাল।

অমিত তার বন্ধুর এমন অকাল প্রস্থান মেনে নিতে পারেনা। মেনে নিতে পারেনা জর্জ ফ্রয়েডের মৃত্যু। বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ব্লাক লাইফ মাটারস এর প্রতিবাদ সভায় ও সারাদিন ব্যানার নিয়ে ঘুরে বেরায় রাস্তায় রাস্তায়। একদিন গভীর রাতে জ্বরে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়, ও বুঝতে পারে ওর কিছু একটা হয়েছে। কাজ করতে অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে, কাঁপুনি দিয়ে আবারও জ্বর আসে। রাতে মায়ের কাছ থেকে ফোন আসে। ওপারে মা আকুল হয়ে বলে চলে- বাজান, প্রতিদিন তোমার ফোনের জন্যে বসে থাকি, তুমি তো বাজান হরহপ্তাহে ফোন কর। বাপ, তোমার শরীরডা ভালো আছ তো? অমিত হেসে বলে মা, আমি ভালো আছি, একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই কল দিতে পারি নি। মা অমিতের কথায় বিশ্বাস রাখতে পারে না। বার বার বলে- বাজান আমায় ছুঁইয়া বল, তোমার গলার স্বর যেন কেমন কেমন লাগছে, বাবা ঠাণ্ডা লাগছে নাতো? কেমন খুক খুক করে ক্যাসতেছ, তোমাদের আমেরিকায় নাকি কি এক পচা রোগ আইছে, খুব ভয়ে থাকি বাবারে? অমিত গলা ঝেড়ে সুস্থ হবার চেষ্টা করে। মা, একটু ঠাণ্ডা লেগেছে, কোন চিন্তে কোর না। ঔষধ খাচ্ছি। মায়ের মন কিছুতেই মানতে চায় না। মা পরের দিন আবারও ফোন করে। ফোন বেজে চলে। অমিত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ফোনের প্রতি। ওর যে শক্তি নেই কথা বলার। সারা জীবনের সঞ্চিত ক্লান্তি তার শরীরে ভর করেছে। নিউইয়র্কের এক ছোট্ট কুঠুরিতে ও লোক চক্ষুর আড়ালে অন্তরালে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে। এদিকে দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত থাকায় ওর সহকর্মীরা ওর খোঁজ পেয়ে তড়িৎ হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসায় কিছুটা ভালো হয়ে উঠলেও কোরনা ওর শরীরে রেখে যায় অনেক জটিলতা। দেখা দেয় কিডনির জটিলতা, ফুসফুসের প্রদাহ।

অমিত, হেরে গেলে চলবে না। তোমাকে আমি যেতে দেব না। তুমি যাবে না অমিত। মারিয়া পাগলের মতো চিৎকার করে উঠে। অমিত কারও কথা শুনতে পায় না, নিজকে বড় বেশি হাল্কা মনে হয়। হাসপাতালের পরিকাঠামো আস্তে আস্তে উদ্বায়ী হয়ে বাতাসে মিশে যায়। অমিত ঊর্ধ্বলোকে ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়াতে থাকে। ওর খুব ইচ্ছে হয় আরও উঁচুতে আরও উঁচুতে উড়তে । অনুভব করে কে যেন তাকে অদৃশ্য সুতোয় তখনো বেঁধে রেখেছে। সুতোয় টান লেগে কোথা থেকে এক গভীর বেদনাবোধ তাকে টেনে নিয়ে আসে নিচে। অমিতের চোখে পড়ে উন্মত্ত যমুনার গা ঘেঁষে বিস্তীর্ণ কাশবনে হারিয়ে যাওয়া তার শৈশব, কৈশোর। জলমগ্ন ধান ক্ষেতে বন্ধুদের সাথে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে অমিতের চোখে পড়ে কাশবনে ছাগল কোলে এক মিষ্টি তন্বী শ্যামা মেয়েকে। মেয়েটার শরীর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। কাশবন জুড়ে ব্যাপ্ত হয় ওর মায়াবী চোখ। সে চোখে মিশে থাকে এক গভীর অভিমান, এক বুকচাপা ক্রন্দন। ওর সাথে ঘর বাধবে বলে অমিত যে ওকে কথা দিয়েছিল! কথা দিয়েছিল এবার দেশে ফিরেই মাকে ও কথাটা বলবে। মাকে বলবে বলবে বলে আর বলা হয়নি। মার সাথে যখনি কথা হয় তখনি অভাব অনাটনের কথা। গত বার দেশে ফিরে বোনটাকে ও পাত্রস্থ করেছে। জানতো না শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এত নির্মম হবে। কথায় কথায় যৌতুকের চাপ দিয়ে বোনটাকে নির্যাতন করে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দেবে। বোনের সুখের জন্য অমিতকে দু’দুটো চাকুরী করতে হয়। অমিত এক গভীর শ্বাস নিতে আকুপাকু করে। আকুপাকু করে আরেকটু বেঁচে থাকতে। ওর যে অনেক কাজ বাকি। বাবার বাশ দিয়ে ঘেড়া কবরটা ভেঙ্গে পড়েছে। গরু ছাগল অনায়াসে ঢুকে পড়ে। বড় আশা বাবার কবরটা সান বাধিয়ে দেবে। সংসারের চাপে নিজে পড়ালেখা করতে পারেনি। ছোট ভাইটিকে নিয়ে তার অনেক প্রত্যাশা। অনেক কষ্টে ওকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছে । এইতো আর দুবছর পরেই ভাইটি পাস করে বেড় হবে।

অমিতের মনে পড়ে ভাইটি একটা লেটেস্ট মডেলের আইফোন চেয়েছিল। সেদিন চন করে মাথায় ওর রক্ত উঠেছিল। রাগে দুঃখে দুটো কথা বলে দিয়েছিল। সে কথা মনে হতেই এক গভীর অনুশোচনাবোধ ওকে বিদ্ধ করে। ও যে এখানে কতো কষ্ট করে, ভাইটি মনে হয় বুঝতে পারেনা, তাইত কিছু না বুঝেই এটা ওটা চেয়ে বসে। ছোট মানুষ তো? অমিত ভেবে রেখেছে এবার দেশে যাবার সময় কিস্তিতে একটা ফোন নেবে। ভাইটি যখন এয়ারপোর্টে আসবে ওকে নিতে, ও পকেট থেকে বের করে ভাইয়ের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে সারপ্রাইজ বলে জড়িয়ে ধরবে! আরও সারপ্রাইজ দেবে ছাগল চড়ানো ঘন কালো ঐ তন্বী মায়াবীকে। হঠাৎ করে পেছন দুয়ার দিয়ে ও যাবে ওদের বাড়ী । ও হয়তো ওর প্রিয় ছাগল গুলোকে কাঁঠালের পাতা খাওয়াতে থাকবে ব্যস্ত। ও পেছন থেকে হঠাৎ করে নাকা সুরে বলে উঠবে- খুকি আমায় একটা কাঁঠাল পাতা দিবি; কতো দূর হতে এসেছি আমি। ও ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে মা মা বলে ডেকে উঠবে। পরক্ষণে ও এসেছে বুঝতে পেরে সলজ্জ হাসি দিয়ে দৌড়ে যাবে পালিয়ে। ও চিৎকার করে বলে উঠবে – বৃষ্টি, পালাবে না, পালাবে না, এবার যে ধরা পড়ার সময় এসেছে…। ‘আমরা যাবো যেখানে যাইনি কেহ সাহস করি, ডুবে যদি তবে ডুবুক না কেন ডুবুক তরী ডুবুক সবি’। বৃষ্টিকে নিয়ে ওর বৃষ্টির মাঝে খুব ভিজতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে ওকে নিয়ে টাংগরের হাওরের উত্তাল জলে ছোট্ট এক ডিঙ্গি ভাসাতে। অমিত দেখতে পায় তার ইচ্ছে ডিঙ্গি খানাকে। ঠাণ্ডা জলে পা নামিয়ে বসে আছে বৃষ্টি। অমিত আঁচলা ভরা জল শূন্যে ছুড়ে দেয় ওকে ভেজাবে বলে। মুহূর্তে সে জল উদ্বায়ী হয়ে শূন্যে যায় উড়ে। এক ঘন কাল মেঘ অশান্ত হয়ে ছুটে আসে ওর দিকে। অমিত ডুবে যেতে থাকে। এক পরম শান্তিতে ডুবে যেতে থাকে হাওরের অতল জলে।

মারিয়া যথাসাধ্য করেও অমিতকে জাগিয়ে রাখতে পারে না। ওর মস্তিষ্কে জমা হতে থাকে কার্বন ডাই অক্সাইড। হটাৎ করে ওর চোখের আলো নিভে যায়। চরাচর জুরে নেমে আসে এক গভীর অন্ধকার। জমাট কালো অন্ধকার ওকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে চক্রাকারে। সৃষ্টি করে সুরু এক সুড়ঙ্গ পথ। অমিত সেই সুড়ঙ্গ পথ ধরে প্রবল বেগে ছুটে চলে। তার আর কোন টান নেই। রোগ-শোক, জ্বরা-ব্যাধি, লোভ, মোহ, মাৎসর্য কেউ আর তাকে পিছে টানে না। ওর মস্তিষ্কের মাঝে কোন এক অজ্ঞাত উৎস হতে বিরাট বিরাট তরঙ্গমালা আঁছড়িয়ে পড়ে। হিপোকাম্পাস থেকে বেড় হয়ে আসে তার যাপিত জীবনের সবটুকু স্মৃতি অধিক জীবন্ত হয়ে। টানেলের গাত্রে স্মৃতিগুলো চলচ্চিত্রের মতো প্রক্ষেপিত হয়। দ্রুত ধাবমান সেই চলচ্চিত্রে অমিত দেখতে পায় তার মাকে, ছোট ভাইটিকে, রাগান্বিত বাবাকে – ঠিক যেমনটা দেখেছিল ছোটবেলায়। সেলুলয়েডের পর্দায় ভেসে ওঠে ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের ছবি। অমিত টাইম স্কয়ারে বিরাট স্ক্রিনে দেখছিল বাইডেন ও ট্র্যাম্পের নির্বাচনী বিতর্ক। ট্রাম্প সেদিন বাইডেনের মাস্ক নিয়ে বিদ্রূপ করেছিল। হিপোকাম্পাস সেই অস্বস্তিকর দৃশ্য মনে রেখেছে। অমিত আমেরিকা থাকলেও সময় পেলেই ওর চোখ পড়ে থাকত বাংলাদেশের বিভিন্ন টক শো গুলোর উপর। টক শোতে পণ্ডিতদের মিথ্যাচার ওকে ব্যথিত করতো। তবুও সে দেখে যেত। দেখে যেত ধূর্ত সাহেদের আলাপচারিতা। পাপুল, পি কে হালদার, সম্রাটের ছবি দেখে রাগে দুঃখে ওর মাথায় আগুন ধরে যেত। আজ সেই ভ্রষ্টাচারীরা যখন তার মনের অন্দর হতে সামনে এসে দাড়ায় ওর কোন ভাবান্তর হয় না। অমিতের মস্তিষ্কে প্লাবিত হয় এন্ডরফিন, সেরটোরিনে। ওরা অমিতের কষ্ট হরণ করে ছড়িয়ে দেয় আনন্দের ফল্গুধারা। অমিত সুরঙ্গের শেষ মাথায় এক ঘূর্ণ্যমান আলোকমালা দেখতে পায়। শরীর থেকে বিমুক্ত হয়ে ক্ষমার অপার আনন্দে স্নাত হয়ে ও ছুটে চলে সেই আলোর পানে। ছুটে যেতে যেতে পর্দায় দেখা মেলে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু টাইসনের সাথে। কাচ ঘেরা এক ছোট্ট ঘরে ও খাটিয়ায় নির্জীব শুয়ে আছে। ওর বৃদ্ধ পিতা-মাতা শোকে বিহ্বলিত হয়ে আছড়ে পড়েছে মাটির পর। করোনা আক্রান্ত মৃত ছেলেকে ছুতে না পারার সুগভীর বেদনাবোধ ছড়িয়ে পড়ে অপরাহ্ণের আকাশে। অমিত নিঃচুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে। নির্মল আকাশ থেকে বিকেলের শেষ আলো টাইসনের মুখে পড়ে কেমন এক অপার্থিব আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ওর নিষ্পাপ মুখটা ক্ষণিক কেপে ওঠে । ও যেন কি বলতে চায়। বাতাসে ওঠে এক মৃদু কম্পন – কর্ণহীন কর্ণকুহরে ভেসে আসে

দেখো আলোয় আলো আকাশ

দেখো আকাশ তারায় ভরা

দেখো যাওয়ার পথের পাশে

ছোটে হাওয়া পাগলপারা,

এত আনন্দ আয়োজন

সবই বৃথা আমায় ছাড়া…

সময় রাজার মতো এসে পার্থীব জগতের সমস্ত হিসেব নিকেশ মিটিয়ে টাইসনকে বুকে টেনে নিয়েছ। অমিত আজ মহাকালের সেই অন্তিম যাত্রার একজন সহযাত্রী।

অসতো মা সদ গময়, তম সো মা জ্যোতির্গময়ঃ

ওম মৃত্যর্মা অমৃতমঃ গময়ঃ

– আমায় জড় জাগতিক বন্ধন থেকে শাশ্বত জগতে, অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে, মৃত্যু ভয় থেকে অমরত্বের দিকে ধাবিত কর।

মারিয়া, অমিতের multi-organ failure. ওকে বাঁচানো যাবে না। তুমি ওর ভেন্টিলেটর খুলে দাও। ডাক্তারের বারংবার অনুরোধ মারিয়ার কানে পৌঁছে না। অমিতের নিথর শরীরের দিকে মারিয়া অপলক তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার অমিতের পাশে নিজে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে একটা চিঠি। মারিয়ার উদ্দ্যেশে লেখা। ডাক্তার চিঠিটা এগিয়ে দেয় মারিয়ার দিকে। মারিয়া চিঠি পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অমিত লিখেছে –

মারিয়া, যদি তোমার স্নেহ ভালবাসা, মাতৃসমা যত্নেও আমার শরীর সাড়া না দেয়, তবে তোমরা আমায় কোন ভেন্টিলেসন দিও না। আমার চেয়েও অনেক অনেক অসহায় মানুষ রয়েছে যাদের ভেন্টিলেসন দরকার। আমার তো তেমন কেউ নেই। অরুণের ছোট ছোট দুটো শিশু সন্তান। অরুণের অবর্তমানে ওরা যে অনাথ হয়ে যাবে ! ওর যে বেঁচে থাকা খুব দরকার। তুমি দেখেছ, প্রতিদিন হাসপাতালের কাঁচের জানালার ওপারে ওর নবপরিনিতা স্ত্রী দুটো শিশু বাচ্চা নিয়ে কি বিষণ্ণ হয়ে অরুনের দিকে তাকিয়ে থাকে ! তুমি ওকে সাহায্য কোর।  যদি ওর ভেন্টিলেসনের প্রয়োজন হয়, তবে আমার জন্য বিলম্ব না করে ওকে দিয়ে দিও। আমি হয়তো অরুনের মাঝেই বেঁচে থাকবো। মারিয়া, তোমার হাতের তামেরা আর বোধ হয় খাওয়া হল না, হল না তোমার গ্রামে যাওয়া। তুমি আমার জন্য কষ্ট পেও না। তুমি ভালো থাকার চেষ্টা কোর।

অমিতের ভেন্টিলেসন খুলে দিয়ে ডাক্তার কাল বিলম্ব না করে চলে যায়। যন্ত্রগুলো বিপ বিপ শব্দ করতে করতে থেমে যায়। নেমে আসে সুমসাম নীরবতা। অমিত পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরুঙ্গের শেষ মাথায় ঘূর্ণায়মান সেই পরাবাস্তব  হরিন্ময় আলোক মালাতে।



দেখো আলোয় আলো আকাশ | ছোট গল্প ।। সুশীল কুমার পোদ্দার ঃ ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

সংবাদটি শেয়ার করুন