ফিচার্ড লেখালেখি

শিশু বলাৎকার ও ধর্ষণ  |  আলিফ আলম 

শিশু-বলাৎকার

 শিশু বলাৎকার ও ধর্ষণ

শিশু সঙ্গম শব্দটি পৃথিবীর মানবিক মানুষদের কাছে এক বিস্ময়কর শব্দ। কিন্তু এর অস্তিত্ব  আমাদের সমাজে আমরা একেবারেই অস্বীকার করতে পারি না। যারা প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষদের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে, শিশুদের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাদেরকে বলে পেডুফাইল বা শিশুকামী। উনিশ শতকের প্রথম দিকে প্রথমবারের মতো এটাকে এক স্নায়ুবিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে যাদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের অভাব, ডিপ্রেশন অথবা বাক্তিত্তের সমস্যা থাকে তারাই কেবল শিশুকামী হয়ে থাকে। তবে সব শিশুকামীরা যে শিশু বলাৎকার করে তাও কিন্তু নয়। শিশুকামীদের মধ্যে অনেক ধরণের বিশিষ্ট রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের প্রকাশ করে, আবার কেউ কেউ করে না। তাদের মধ্যে অনেকে শিশুদের ক্ষতি করার জন্য সদা প্রস্তত থাকে আবার কেউ কেবল ছেলে শিশুদের প্রতিই আকৃষ্ট হয়।

তবে আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ছেলেদের মাঝেই এই শিশুকামী হবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে মেয়ে শিশুকামীর সংখ্যা খুবই নগণ্য বলা চলে। যখন কোন শিশুর বয়স দশ কিংবা এগারো হয় তখন যদি তার মাঝে কোন কারণে সেক্সচুয়াল ডিসঅর্ডার দেখা দেয় এবং তারা যখন বড় হয় অনেক সময় তা শিশুকামীতায় রুপ নেয়।
তবে এই শিশু সঙ্গম কি কেবল অপরাধ, নাকি বিশ্বাস? ভারতের অনেক জায়গায় এটা বিশ্বাস করা হয় যে, শিশুদের সাথে সঙ্গম করলে অনেক রোগ-বালাই ভাল হয়ে যায়। আর এই বিশ্বাস  থেকেই তারা শিশু ধর্ষণে লিপ্ত হয় যার প্রভাব সমাজে ভয়ঙ্করভাবে দেখা দেয়।

 

শিশু বলাৎকার ও ধর্ষণ – ঘটনা ১ 

রাকিবের বয়স তখন সবে সাত। বিকেল হলেই কচি আঙুলের ডগায় সুতো পেঁচিয়ে প্রতিদিন তার ঘুড়ি উড়াতে হয়। অংক খাতায় তার হাজার মনের আঁকিবুঁকি। বাবা মা দুজনেই কাজের চাপে ব্যস্ত থাকেন। রাকিবকে আলাদা করে সময় দেবার মত তাদের সময় মেলে না। তাই একদিন গ্রাম থেকে এক আত্মীয়কে আনা হয়েছে রাকিবের দেখাশুনার জন্য। রাকিব তাকে চাচা বলে ডাকে। রাকিবকে স্কুলে আনা নেয়া, সময় মতো খাবার দেয়া, ঘরের কিছু কাজ, সবই এই চাচাকেই সামলাতে হয়।

একদিন রাকিবকে গোসল করাতে গিয়ে, উনি কি ভেবে তার গোপন অঙ্গে হাত দিয়ে বসলেন। প্রথমে বিষয়টা রাকিবের কাছে একটু অস্বস্তিকর মনে হলেও ব্যাপারটা সে তেমন বুঝে উঠতে পারিনি। এর ঠিক কিছুদিন পর রাকিবকে জোর করে এক প্রকার বাধ্য করা হয় ঐ চাচার  সাথে সঙ্গম করতে। সেদিন রাকিবের উপর নেমে এসেছিল এক কালো মেঘের ছায়া। পায়ুপথের অসহ্য ব্যথায় সে ছটফট করছে কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছে না, কেবল তাই নয়, এ কথা কাউকে বললে তার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে, সে কথাও তাকে প্রতিদিন সময় করে মনে করিয়ে দেয় গ্রাম থেকে আসা সেই চাচা। এই ভয়ে কোনোদিন সে কাউকে বলিনি। বলেই বা  কি কোন লাভ হবে? বাবা মা দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চাকরি করে। তার যে একাই থাকতে হয় এই লোকের সাথে। প্রথমবারের এই শারীরিক অভিজ্ঞতা তার কাছ ভয়ঙ্কর লেগেছিল যা ভাবতেই তার গা শিউরে উঠে। মাঝে মাঝে সে ভেবে দেখেছে যে, সে তো ইচ্ছে করলেই চিৎকার করতে পারত কিংবা বাবা-মা বাড়ি ফিরলে তাদের তা বলতে পারত। কিন্তু এমন কিছু  করার চেষ্টা রাকিব  কখনও করেনি  আর করলেও সে কি ওনার সাথে গায়ের জোরে পেরে উঠত? ততদিনে উনি বাবা মায়ের কাছে তার কাজ আর রাকিবের প্রতি দায়িত্বে পালনের জন্য অনেক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে।

এই ঘটনার পর থেকেই আচমকা তার পৃথিবী বদলে গেল। ধু ধু করে দূরে সরে যেতে লাগল তার প্রিয় খেলার মাঠ। এই অসম, বিকৃত কাজের স্বাদ পেতে পেতে তার বারবার মনে হতে লাগল, এ কাজ কি তার মতো আরও অনেকের সাথে ঘটেছে নাকি কেবল তার সাথে? তার ছোট ঘরের নীলরঙা গ্রিলে নরম হাতের আঙুল জড়িয়ে তার কেবলেই মনে হয়, এই পৃথিবী তার   জন্য রঙ বদলে ফেলেছে যা আজকাল তার কাছে বড় বিবর্ণ লাগে। জানালার ওপাশে প্রতি বিকেলে দূর আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি উড়ে বেড়ায়, এ সব কিছু তার কাছে এখন স্বাদহীন দৃশ্য।

বিকেল হলেই তার খুব একা লাগতে শুরু করে। বাইরে মাঠে তার বয়সি ছেলেরা খেলা করে। কিন্তু তার বুকে খিচ ধরে উঠে ব্যথায়। তার চোখের সামনে ফাঁকা মাঠ,  সে দৌড়ায়, পড়ে  গিয়ে আবার উঠে, দুর্বল লাগে তার, মাথা ঝিম ধরে আসে। মাঝে মাঝে বাবা মাকে সব খুলে বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তার সাহসে কুলায় না।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর তাকে দেখে চাচা মৃদু হাসে, ভয়ংকর কুৎসিত সে হাসি। তাকে  যত্ন করে গোসল করিয়ে, খাইয়ে লোকটা ঘরময় অস্থির ভাবে পায়চারি করে, সিগারেট ধরায়। বদ্ধ ঘরে সিগারেটের ধোঁয়া আটকে থাকে। রাকিব সব খেয়াল করে। তারপর লোকটা তার দিকে মন্থর পায়ে এগিয়ে আসে। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে চাচার কামচোখ। ভয়ে তার পা ভেঙ্গে যায়। প্রতিবার তার মনে হয় এটা অসম্ভব, সে আর তা পারবে না কিন্তু সে পারে! তাকে পারতেই  হয়।

এভাবে দিনের পর দিন এক অচেনা পৃথিবীতে চলে যায় রাকিব। মাঝে মাঝে মা বাড়ি ফিরলে,   মায়ের কাছে অস্থির ভাবে রাকিব ছুটে আসে। মায়ের বুকে গোপনে সে তার দীর্ঘ শ্বাস লুকায়। মুখ তুলে মাকে দেখে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে মাথায় চুমু খায় কিন্তু তার ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা তার মা কোনভাবেই টের পায় না।

চাচা দেখতে অনেকটা হাড়গিলে, রোগা আর চতুর এক গ্রাম্য মানুষ। খুব গ্রাম্য তার হাবভাব, বিশ্রী ভঙ্গি করে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলা তার অভ্যাস। কাজের প্রতি তার একাগ্রতা আর রাকিবের প্রতি বিশেষ যত্ন-আত্তি তার বাবা মায়ের কাছে চাচাকে খুব আস্থাশীল করে তুলেছে। একদিন অন্য দিনের মতো বাড়ি ফিরে একটু চমকে গেলো রাকিব। তার চাচা আজ গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে! মেঝেতে তার ব্যাগ আর জামাকাপড় রাখা। চলে যাবার সময় আড়াল থেকে রাকিবকে যত্ন করে, একবার আড়চোখে দেখে নিল। আজ গালের দাড়ি পরিস্কার  কামানো, রোগা কালো বলে তার চোয়াল চৌকো হয়ে আছে। মাথায় তেল দিয়ে পরিপাটী করে চুল আঁচড়ানো। তার চলে যাওয়া দেখে রাকিব চুপ করে থাকে, কিছু বলে না। চাচা চলে যাবার  পর থেকে আর কোনদিন সে তাকে দেখেনি।

কিন্তু এরপর তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় সে কোনদিন কাউকে বলিনি। রাকিব যখন শিশু থেকে  কিশোর হয়ে উঠল, একদিন সে আবিষ্কার করল মেয়েদের থেকে ছেলেদেরকে তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। মাঝে মাঝে বন্ধুদের আড্ডায় হাসির ছলে এ কথা সে বহুবার বলেছে। কথাগুলো তার কাছে যতখানি না সত্য, বন্ধুদের  কাছে তা ছিল তার চেয়েও বেশি  হাসির।

এরপর থেকেই তার ভিতরের ঘোর ভাঙতে শুরু করল। একদিন তার মত কাউকে সে পেয়েও যায়। তার শরীরের ভিতর সে যে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ করে, তার প্রকাশ হয় এক প্রকার আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মাধ্যমে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিকর্ষণের অনুশাসন ভেঙ্গে। এরপর থেকেই তার এক নতুন জীবন শুরু।

মাঝে মাঝে মাঝরাতে সে প্রায়েই জেগে উঠে। খুব অস্থির লাগে তার। আর দশজন ছেলেদের মত মেয়েদের চেহারা কিংবা শরীর তাকে আকর্ষণ করে না। সে কিছুতেই ভাবতে পারে  না একদিন তার সংসার হবে, বিয়ে করবে , কিংবা  বউ এর সাথে সে এক বিছানা ভাগ করবে বরং তার মনে হয় সে আর সব ছেলেদের মতন নয়। তার মাঝে এমন কিছু ঘটে যা অনেকের মাঝে ঘটে না। পৃথিবীর সব কিছু তার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও কেবল তার কামভাব তার কাছে অন্য মাত্রায় ধরা দেয়। সে নিজের সাথে অকপটে স্বীকার করে সে একজন সমকামী! সে বহুবার চেষ্টা করেও এই সম আকর্ষণ থেকে বের হতে পারিনি। তার কাছে এটা অনেকটা সুইমিংপুলে একটা বলকে পানিতে ডুবিয়ে রাখার মতো, যা হাজার চেষ্টায় ও পানিতে ডুবে  থাকে না বরং বারবার উপরে ভেসে উঠে আসতে চায়। এর জন্য সে বহু ডাক্তার এর কাছে ও গিয়েছে। যেভাবেই হোক এই শরীরকে তার সারাতেই হবে। কিন্তু আসলে সমস্যা তার শরীরে নয়, ছিল মনে।

এক সময় সে জানতে পারে সে সমকামী হয়ে জন্মায়নি! তার সাত বছর বয়সে তার সাথে ঘটে যাওয়া সেই গ্রাম্য চাচার বিকৃত আচরণই তাকে সমকামী করেছে,  যা সারাজীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। রাকিবের  সুদর্শন চেহারা, চকচকে চোখ  আর  বিনয়ী স্বভাবের মাঝেও ভিতরে সে একজন ভিতু, দুর্বল আর অস্থির মানুষ। সে জানে এভাবেই তাকে সারাজীবন চলতে হবে।

 

শিশু বলাৎকার ও ধর্ষণ – ঘটনা ২

প্রেমার বয়স তখন সাত বছর হবে। প্রতিদিনকার মতো সে বিকেল হলেই পাশের বাসার উঠোনে খেলতে যায়। আশপাশের বাড়ি থেকে আরও অনেকে খেলার জন্য তার সাথে এসে জড়ো হয়। প্রতিদিনকার মতো আজও সে মাটি আঁচড়ে এক্কা দোক্কা খেলার ছক বানাতে ব্যস্ত। সুন্দর ফর্সা চেহারার প্রেমাকে আজ লাল ফ্রক আর ঝুঁটিতে দারুণ দেখাছে।

পাশের বাসায় আজ তেমন লোকজনের চলাচল নেই, দরজা জানালা বন্ধ। মনে হয় কেউ বাড়ি নেই, কাকা ছাড়া। কাকা এমনিতে খুব ভাল। প্রেমাকে দেখলেই হেসে মাথায় হাত বুলায়,  মাঝে মাঝে কানের লতি আলগোছে ধরে আলতো করে টেনে দেয়। কেমন আছে জিজেস করে। কখনও কখনও চকলেট দেবার সময় হেসে মাথায় ঠুস করে থাপ্পড় বসিয়ে আলতো করে তার গাল টিপে দেয়। প্রেমার বাবা মা দুজনেই জানে পাশের বাড়ির কাকা তাকে খুব আদর করে। আজ কেউ বাড়ি নেই বলে চারদিক খুব নিস্তব্দ। খেলার সাথীরা এখন ও আসেনি। হঠাৎ দরজা ঠেলে চকমক চোখে হাসতে হাসতে কাকা বের হয়ে এলেন। পরনে চেক লুঙ্গি আর ধূসর রঙের শার্টের হাতা হাতের কনুয়ের কাছে ভাঁজ করা। চকলেট গায়ের রঙ আর হালকা শরীরের গড়ন তার। সবসময় মাথার সামনের দিকে ফাঁপিয়ে চুল আঁচড়ায় বলে তাকে খুব পরিচ্ছন লাগে। কিছুক্ষণ পর খুব ধীর পায়ে ঘরের কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে প্রেমা কে বলল
__কি রে! কি করিস?
___কিছু না, খেলার ছক বানাই, মাটিতে আঁচড় কাটতে কাটতে অন্যমনস্ক ভাবেই উত্তর দেয় প্রেমা।
___তোর বন্ধুরা তো এখনো আসে নাই দেখছি , চল আজ আমার সাথে খেলবি।
___প্রেমা কোন কিছু না ভেবেই বলল, কি খেলব তোমার সাথে?
___চল যাই ভিতরে, তোকে দেখাই, তোর বান্ধবীরা আসলে আবার চলে আসবি।

প্রেমা ভাঙ্গা মাটির কড়ি ফেলে সরলমনে কাকার সাথে ঘরে গেল। দরজা জানালা বন্ধ থাকায় ঘরে একটা গুমোট ভাব। সাদা লাইটের আলোয় চারপাশ খুব ফ্যাকাসে দেখাছে। এদিকে কাকা খুব সাবধানে নিস্তব্ধে দরজার খিল দিল। প্রেমা কিছু বুঝার আগেই তার কপালের কচি চুল সরিয়ে তাকে বিছানায় নিয়ে যায় কাকা।

_চল, আমরা বিছানায় বসে খেলি। প্রেমা সরলভাবে মাথা দুলিয়ে বলল, চলো।

বাড়িতে কেউ নেই, এই তো সুযোগ। এতদিন মুঠোফোনের পর্দায় যে উলগ্ন শিশুদের সে দেখেছে, আজ এমন কিছু তার সাথে হতে যাচ্ছে, এটা ভাবতেই এক অন্যরকম আনন্দের শিহরণ হচ্ছিল কাকার এমন একটা সুযোগ আর দিনের অপেক্ষায় থেকে থেকে সে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। প্রেমাকে সে সব সময় নজরে রাখত কারণ ওকে যে তার খুব পছন্দ।

মুখখানা বিকৃত করে প্রেমার সাথে সে তার বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। কাকার ব্যবহার প্রেমার কাছে আজ খুব অচেনা লাগছে। তার খুব ভয় আর অস্বস্তি হচ্ছে।

_আমাকে ছেড়ে দাও। নইলে মায়ের কাছে যেয়ে সব বলে দিব।
___যদি বলিস তো তোকে আমি মেরে ফেলব, মনে রাখিস। প্রেমা বারবার ভয়ে, আশংকায়  কাকার কাছ থেকে ছুটতে চেয়েছে কিন্তু এমন যুবক কাকার শক্তির কাছে সে একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। বিছানায় থর থর করে কেঁপে ওঠে তার শরীর। কি ঘটছে তার সাথে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাগে, ঘেন্নায় সে বারবার চিৎকার করতে চায় কিন্তু কাকা এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।  সে খেয়াল করে তার চোখের সামনে কাকার অস্থির দুটো লালরঙা চোখ আর দুটো চোয়াল বদ্ধ হাতের মতো শক্ত হয়ে তার কপালের শিরা ফুলে উঠেছে।

প্রেমা হাত দিয়ে কাকার বুকে ধাক্কা দিয়ে অস্থিরভাবে বলে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাড়ি  যাব। এইতো আর একটু পর আমার খেলা শেষ, তোকে ছেড়ে দিব। এর কিছুক্ষণ পর কাকা তাকে সত্যিই ছেড়ে দেয়। খেলা শেষে সেদিন বিছানার কুঁচকানো চাদরে ফিকে হয়েছিল প্রেমার জ্বলজ্বলে শৈশবের রঙ। প্রেমা বুঝতে পারে তার শরীর কাঁপছে, খুব দুর্বল লাগছে তার। হাঁটতে যেয়ে পা কাঁপছে, টলমল করছে মাথা।

সেদিন শান্ত ভাবেই  প্রতিদিনকার মতো খেলা শেষে যেমন সে বাড়ি ফিরে, আজও তেমনি ফিরেছে। সে টের পায় তার যোনিপথে প্রচণ্ড ব্যাথা আর তার সাথে ডান পা বেয়ে গড়িয়ে  পড়ছে একটা লাল রক্তের লাইন । কাকা বারবার বলেছে কাউকে কিছু বললে সে তাকে মেরে ফেলবে। তাই সে এখন পর্যন্ত কাউকে কিছু বলছে না। কিন্তু তার মা প্রেমার পা বেয়ে গড়ানো রক্ত আর লাল ফ্রগে রক্তের ছোপ দেখে ভুত দেখার মতো  চমকে গেল।

সেদিন রাত থেকেই প্রেমার গা কেঁপে জ্বর। মা তার দিকে ঝুঁকে প্রেমার গালে গাল ঠেকিয়ে জ্বর বুঝবার চেষ্টা করল। মা বারবার তার কাছ থেকে কি হয়েছে জানতে চেয়েছে কিন্তু প্রতিবারই জ্বরবিকারের মতো অনেক এলোমেলো কথা বলে প্রেমা।  মেয়ের অবস্থা খারাপ দেখে বাবা মা  প্রেমাকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যায়। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার নিশ্চিত হয় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তার হাইমেন নামক পর্দা ফেটে যাওয়া আর যোনিপথের অভ্যন্তরীণ আঘাতের জন্য খুব রক্তপাত হচ্ছে। চটজলদি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর কিছুদিন পর হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু তার আগের সেই উদ্দম নেই, কেমন যেন মন মরা হয়ে চুপ করে থাকে।

মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিষয়টা পারিবারিকভাবে বাবা মা চেপে যায়। মেয়ের জন্য অন্য জায়গায় তারা বাসা বদল করে। সময় গড়িয়ে প্রেমা এখন বয়ঃসন্ধিতে পড়েছে। কাকার বয়সি কাউকে দেখলেই মাঝে মাঝে তার বুক কেঁপে উঠে। তার শরীর ছাপিয়ে সমস্ত রক্তস্রোত তার মস্তিষ্কে উঠে আসে। সে ক্ষেপে গিয়ে নানা রকম পাগলামি  করে। তার মনে যে ঘটনা সারা জীবনের জন্য আঁকা হয়ে গেছে, তা আর কখনও মুছবে না বোধ হয়।

এ ব্যাপারে আমাদের দেশের Dr. Shusama Reza (MMBS , MD,  Lead of Sexologist and  Head of Sexual Medicine Unit ) যা বলেন, আমাদের শিশুদেরকে শৈশবের যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষিত রাখতে হলে তাকে ছোটবেলা থেকেই এ ব্যাপারে ধারণা দিতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। শিশুকে বুঝানোর দায়িত্ব বাবা-মা, দাদা-দাদী, ভাই-বোন যে কেউ নিতে পারে।  শিশুর বয়স আর বুঝার ক্ষমতা বুঝে আমরা এই আলোচনা করতে পারি। তবে শিশুকে আমরা কোন ভাবেই ভয় দেখাব না।

প্রথমত, একটি শিশুর গোপন অঙ্গ বা প্রাইভেট পার্টস বলতে আসলে কি বুঝায় তা আমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পারি এবং শিশুদেরকে আমরা বলতে পারি, তোমার এই গোপন অঙ্গ শুধু তোমার। এখানে অন্য কারো ধরার অধিকার নেই, তুমি ছাড়া। কেউ যদি তোমার গোপন অঙ্গ ধরতে চায়, এটা যেমন তুমি করতে দিবে না তেমনি অন্য কেউ তার গোপন অঙ্গে তোমাকে  ধরতে বলেও তুমি তা ধরবে না। দ্বিতীয়ত, আপনার শিশুকে ভাল স্পর্শ আর খারাপ স্পর্শ বিষয়টা কি তা সঠিক ভাবে বুঝিয়ে বলুন। সহজ ভাবে বলতে গেলে যে স্পর্শ তার ভাল লাগে যেমন বাবা-মা কিংবা চাচুর আদরের চুমু, যাতে একটি শিশু সুখ বা নিরাপদ অনুভব করে তাই ভাল স্পর্শ। আর যে স্পর্শ পেলে প্রথম কথা তার একেবারেই ভাল লাগে না, তার খুব অস্বস্তি কিংবা ভয় হয়, অনিরাপদ লাগে সেটাই খারাপ স্পর্শ।

আপনার শিশুকে এই বিষয় গুলো বারবার বুঝিয়ে বলুন। যদি কখনও কেউ তোমাকে খারাপ স্পর্শ করে তবে তুমি তিনটি কাজ করবে। এক, জোরে চিৎকার করা। দুই,  সেখান থেকে দৌড়ে চলে আসা আর তিন, এসে বাবা মাকে বলা। আপনার শিশুকে আগে থেকেই বলে রাখুন কে কে তার জন্য নিরাপদ। এমন কিছু ঘটলে সে কার কাছে এসে প্রথমে কথাগুলো বলতে পারে, তা তাকে জানিয়ে রাখুন। শিশুকে নির্ভয়ে বলুন, কেউ যদি কখনও তোমার সাথে এমন করে তবে তুমি বাবা মায়ের কাছে বলবে। বাবা মা সব সময় তোমার পাশে রয়েছে, আমরা কোনদিন  তোমাকে ভুল বুঝবো না। তোমার চারপাশে অনেক ভাল মানুষ আছে কিন্তু কেউ কেউ খারাপ মানুষ ও আছে যারা শিশুদের খারাপ স্পর্শ করে। তবে পৃথিবীর প্রতি খারাপ ভাব নিয়ে আপনার শিশু যেন বড় না হয়, সে দিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখুন।

মূলত যারা শিশুদের যৌন হয়রানি বা শিশু বলাৎকার করে তারা সবসময় পরিবারের খুব কাছের মানুষ অথবা শিশুর খুব কাছের মানুষ হয়ে থাকে। তাই যেই এই কাজ করুক না কেন, আপনার শিশু যেন আপনার কাছে এসে নির্ভয়ে এটা বলতে পারে,  এমন একটা সম্পর্ক তার সাথে গড়ে তুলুন।

তাছাড়া ধর্ষণের মতো ঘটনার ক্ষত একটা শিশুর মনে সারাজীবন রয়ে যায়,  জীবনে এর প্রভাব ভয়াবহ। এর ফলে একটা শিশু নানা ধরনের আচরণগত পরিবর্তন ও নানাবিধ মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। কোন শিশু যখন শিশু বলাৎকারের শিকার হয়, তখন এর খারাপ প্রভাবের সাথে নিজেকে সে কোনভাবেই খাপ খাওয়াতে অথবা এর সাথে মোকাবেলা করতে পারে না। এমতাবস্তায় আমরা যদি শিশুকে সাহায্য না করি তবে তাদের মাঝে ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতা আর আত্মহত্যা করার মতো প্রবণতা ও দেখা দিতে পারে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই মানসিক সমস্যা অনেক দীর্ঘমেয়াদী হয়। সেক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন ধরনের কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি।

আপনার শিশু আপনার অস্তিত্বের অংশ আর সারাজীবনের আনন্দের সম্পদ। শিশু শৈশবে কিংবা কৈশোরে কার সংস্পর্শে আসছে তা নজরে রাখুন। বাবার বন্ধু, স্কুল শিক্ষক, টিউটর,  কাছের কিংবা দূরের আত্মীয় স্বজন যেই হোক না কেন, তারা আসলে কতখানি আমাদের শিশুদের জন্য নিরাপদ তা দেখার দায়িত্ব আমাদের। আমাদের শিশুদের সুরক্ষা আমাদেরই হাতে। আমাদের সচেতনতা আর ছোটবেলা থেকেই শিশুদের যৌন হয়রানি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানই পারে শিশুদের উপর ধর্ষণের মতো এমন বিকৃত, বাজে অন্যায় আচরণ ঠেকাতে।

শিশু বলাৎকার ও ধর্ষণ  |  আলিফ আলম – লেখক। মন্ট্রিয়ল

 

এস এস/সিএ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + twelve =