ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

নৈঃশব্দের আবরণ ভাঙ্গিয়া অবলার মনের মাঝে কোথা হইতে ঢং করিয়া এক শব্দ তরঙ্গ আছড়াইয়া পড়িল। সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল শীর্ণ দেহ, দরিদ্রকৃষ্ট তাহার মহান শিক্ষককে। আস্তে আস্তে জাগিয়া উঠিল শৈশবের সেই স্মৃতিমাখা স্কুলঘর। পণ্ডিত স্যার তাহার সুন্দর হস্তাক্ষরে বোর্ড জুড়ে লিখিয়া রাখিয়াছেন – পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, অপরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত কর। অবলা কতোবার ঐ সুদূর কথামালাকে সম্প্রসারিত করিয়া, ভাঙিয়া চুরিয়া, তাহার মাঝে লুকায়িত নির্যাসটুকু হৃদয়ঙ্গম করিতে চেষ্টা করিয়াছে। একদা সে সেই কথার মর্মার্থ বুঝিতে পারিলেও, আজ তাহার মনে নতুন প্রশ্ন জাগিয়া উঠিল। পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না… কে এই সুন্দর নৈতিক কথাগুলো লিখিয়াছেন – অবলা তাহা জানে না। তবে, নিশ্চয়ই তিনি ভাবাবেগে তাড়িত হইয়াই এমন কথা লিখিয়াছেন। পুষ্পকে জিজ্ঞাস করিলে নিশ্চয়ই পুষ্প এমন কথা বলিত না। হয়তো পুষ্প বলিয়া উঠিত – তোমরা মানুষেরা নিজকে শ্রেষ্ঠ ভাবিয়া নিজের ইচ্ছায় আমাদের নাম রাখিয়াছ, আমাদের সম্পর্কে মনগড়া কথা বলিয়াছ। তোমরা ভাবিয়াছ আমাদের সার্থকতা তোমাদের সেবা করিয়া। তোমরা মূর্খ , তোমরা অর্বাচীন তাই তোমরা আমাদের কথা বুঝিতে পার নাই। তোমরা মহাশূন্য জয় কর, অথচ তোমাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের ভাষা বুঝিবার মতো কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করিতে পারে নাই। আমাদেরও ভাষা আছে, আমরাও কথা বলি। হয়তো তোমাদের মতো আমাদের কোন কণ্ঠ নাই। কিন্তু, আমরাও একে অপরের সাথে তথ্য আদান প্রদান করি তরঙ্গের ঢেউ তুলিয়া। আমাদের কেহ আক্রান্ত হইলে, আমরা তরঙ্গ সংকেত পাঠাইয়া সতর্ক করি আমাদের নিকটতম আত্মীয় স্বজনকে। আমরা কষ্টে কাতর হই, আনন্দে উদ্বেলিত হই। অবলার মনে পড়িল – এইতো সেদিন খবরের কাগজে বেড় হইয়াছে – ব্রিটেনের একদল বিজ্ঞানী পাঠোদ্ধার করিতে পারিয়াছে ব্যঙ্গের ছাতার কথোপকথন । আবিষ্কার করিয়াছে তাহাদের শব্দভাণ্ডারের প্রায় ৫০ রকম প্যাটার্নকে।

অবলা মহাকালের পথ ধরিয়া প্রবল বেগে আগাইয়া চলিল। ক্ষণে ক্ষণে তাহার যাত্রাপথের দৃশ্যপট বদলাইতে লাগিল। একের পর এক যবনিকা পার হইয়া অন্ধকার তমসাচ্ছন্ন পৃথিবীকে পিছেনে ফেলিয়া ওরা পা রাখিল নতুন এক সবুজ পৃথিবীতে। বর্ণাঢ্য ফুলেল প্রকৃতির মাঝে তাহার চোখে পড়িল গাছে গাছে বিচরণরত ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী। ওরা তাহাদের দিকে ক্ষণিক চাহিয়া ঘন জঙ্গলের মাঝে হারাইয়া গেল।

অবলা আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পেছনে ফেলিয়া তোমার অনেকটা পরিচিত জগতে চলিয়া আসিয়াছি। দেখ, উভচর প্রাণী ব্যাঙ, সাপ, কুমির, আকাশে দন্তহীন পাখী। ঐ দন্তহীন পাখীরাই কিন্তু ডাইনোসরের উত্তরসূরি, ওরা মহা ধ্বংসযজ্ঞ হইতে কোন ক্রমে বাঁচিয়া গিয়াছে। জান অবলা, এই পৃথিবী কতো ভাঙ্গা গড়ার মাঝে আজকের এই রূপ পাইয়াছে ! একসময় যে অখণ্ড মহাদেশ পাঞ্জিয়াতে বিরাটকার ডাইনোসরেরা বিচরণ করিয়া বেড়াইত উহারা কালের এক আক্রোশে নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। মহাশূন্য হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে হিমালয়ের চেয়ে বড় এক দৈত্যাকার উল্কাপিণ্ড। প্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটার বেগে হিরোশিমায় প্রক্ষেপিত পারমানবিক বোমার চেয়ে শত কোটি গুন তীব্রতায় আছড়াইয়া পড়িয়াছিল মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে। ব্যাঙের ছাতার মতো আগুন আর ধূম্রজালে পরিবৃত হইয়াছে আকাশ। ফুঁসিয়া উঠিয়াছে আদিম সমুদ্র। প্রায় ত্রিশ তলা অট্টালিকাসম ঢেউ আছড়ে পড়িয়াছে ভূখণ্ডে। তীব্র চাপে-তাপে পৃথিবীর জঠর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে অসংখ্য ভারি পদার্থ। সেই জ্বলন্ত পদার্থ পিণ্ড ফুলঝুরির মতো ঝড়িয়া পড়িয়াছে পৃথিবীর উপর। দাউ দাউ করিয়া প্রজ্বলিত হইয়াছে বনাঞ্চল।মুহুমুহু ভূমিকম্পের তীব্রতায় ফুঁসিয়া উঠিয়াছে আগ্নেয়গিরি। দৈত্যাকার ডাইনোসরেরা প্রায় কেহই পালাইতে পারে নাই। পৃথিবীর প্রায় তিন চতুর্থাংশ মাত্র দশ ঘণ্টার মাঝে পরিণত হইয়াছে ধ্বংসস্তূপে। এই সংঘর্ষে প্রক্ষেপিত ছাই-ভস্মে ঢাকা পড়িয়াছে সূর্য, পৃথিবী জুড়িয়া নামিয়া আসিয়াছে নিকস কালো অন্ধকার, এক প্রলম্বিত পারমানবিক শীত। দীর্ঘ সময় আকাশ হইতে ঝড়িয়া পড়িয়াছে অবিশ্রাম ধারায় এসিড বৃষ্টি। সামুদ্রিক জীবের এক বিরাট অংশ নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। সুদীর্ঘ কাল ধরিয়া একক এবং অভিন্ন মহাদেশ পাঞ্জিয়াতে যে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া শুরু হইয়াছিল, উল্কাপিণ্ডের সংঘর্ষ সে প্রক্রিয়াকে করিয়াছে ত্বরান্বিত।

অবলা, তোমার জীবৎকাল হইতে ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বের ঐ ধ্বংসযজ্ঞ হইতে উঠিয়া দাঁড়াইতে পৃথিবীর লাগিয়াছে অনেকটা সময়। মহাকালের হিসাবে তাহা সামান্য হইলেও সময়ের হিসাবে তা কয়েক হাজার বছর। এই কয়েক হাজার বছরের মাঝে ডাইনোসরের স্থান পূরণ করিয়া লইয়াছে অধিকতর ক্ষুদ্র প্রাণী। নতুন পৃথিবীতে জন্ম লইয়াছে পাম, আখরোট, মটরশুঁটি, ডাল সহ অনেক প্রোটিন জোগানদাত্রী বৃক্ষ ও খাদ্যশস্য। আর এই প্রোটিনের জোগান যতো বাড়িয়াছে, প্রাণী জগতে আসিয়াছে ততো বৈচিত্র্য । ডাইনোসরত্তোর নতুন পৃথিবীতে পুষ্পক বৃক্ষ-লতা আরও বেশী বিকশিত হইয়াছে।ওরা সময়ের সাথে সাথে উদ্ভাবন করিয়াছে আরও হরেক রকম কৌশল। কেহ তাহার পুষ্প-পত্রে বাহারি রঙ্গের আলপনা আঁকিয়া, কেহ তাহদের পুংকেশরে মধু সঞ্চয় করিয়া কীট -পতঙ্গকে প্রলুব্ধ করিবার পন্থা উদ্ভাবন করিয়াছে।

অবলা জান, তোমরা ফুলের এমন মোহনীয় সৌন্দর্য, পাগলকরা ঘ্রাণের মাদকতায় আত্মহারা হইলেও আদি মানবগোষ্ঠীর মাঝে তখনো কিন্তু সুকুমার বৃত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নাই,। তবুও তারা ফুল দেখিয়া কেন উল্লাসিত হইত, জান? তারা উল্লাসিত হইত ক্ষুন্নিবৃত্তি, লোভ, আর অনাগত কিছু প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায়…

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন