ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

…. প্রকৃতি মানুষকে সামাজিক বন্ধনে বাঁধিয়া রাখিবার জন্য ত্যাগের মাঝে, দানের মাঝে সুখের বীজ বপন করিয়া দিয়াছে – প্রকৃতির এ অমোঘ সত্য অবলার চোখে আজ নতুন ভাবে ধরা দিল। সে তাহার জীবনে অনেক কিছু দেখিয়াছে – অত্যাচারী জমিদার প্রজাদের জন্য বিশাল দিঘী খনন করিয়া দিয়াছে। সেই দিঘীর নাম রাখিয়াছেন তাহারই কোন মৃত সন্তানের নামে – সবার মাঝে তাহাকে জীবিত রাখিবার প্রয়াসে। অত্যাচারী রাজন্যবর্গ প্রজাদের শোষণ করিয়া, তাহাদের অর্থেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিয়াছেন। সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচিতি পাইয়াছে তাহারই প্রিয়তমা পত্নী, পিতা, মাতা অথবা নিজেরই নামে। প্রকৃত পক্ষে মানুষকে শোষণ করিয়া, শাসন করিয়া বিত্তের পাহাড় গড়িয়া তোলা ধনাঢ্য ব্যক্তির দানের মাঝে সে প্রত্যক্ষ করিয়াছে তাহাদের অমরত্ব লাভের প্রচেষ্টা। তাহাদের এই দান, আপাত ত্যাগ তাহাদের যাপিত জীবনের আহার, বিহার আর ভোগেরই সমার্থক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিপত্তিশালী রাজনৈতিক নেতা, অথবা আয়ের সাথে ব্যয়ের ব্যাপক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের বন্যাদুর্গত অথবা মঙ্গাক্রান্ত অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণের ছবি সে যতবার দেখিয়াছে ততবার ব্যাধিত হইয়াছে। একজনকে যৎসামান্য ত্রাণ প্রদান করিতে যাইয়া তাহাদের সাথে আরও অসংখ্য মোসাহেবদের হুড়োহুড়ি করিয়া হাসি মুখে ছবি তোলার প্রতিযোগিতার মাঝে সে প্রত্যক্ষ করিয়াছে নির্মম রসিকতা। তবে সব বিত্তবানেরই যে দানের মাঝে ভোগের আস্বাদন পায় তাহা কিন্তু নয়। বিল গেটস, জামসেদ টাটার মতো বিত্তবানেরা যখন মানবতার পাশে আসিয়া দাড়ায়, আফ্রিকার সুবিধা বঞ্চিত মানুষের হাতে তুলিয়া দেয় সুপেয় জল – তখন তাহাদের মনোজগৎ যে সুখের এক গভীর আনন্দরসে আপ্লুত হয় সেই সুখের আস্বাদন পাইতে অবলার বড় মন চায়।

অবলার মনে পড়ে এক গৌরিক সন্ন্যাসীর কথা। সে তাহার সবটুকু দান করিয়া অশেষ দারিদ্রকে আবাহন করিয়াছিলেন। তাহার না ছিল মাথা গোঁজার ঠাই, না ছিল কোন অন্ন সংস্থান। কিন্তু তাহার মুখে ছিল নির্মল হাসি। চেহারায় ছিল এক স্বর্গীয় দ্যুতি। সমাজে যাহাদের অনেক কিছু আছে, তাহা হইতে যৎসামান্য দান করার মাঝে হয়তো আনন্দ নিহিত আছে, কিন্তু যে সবটুকু দান করিয়া নিজকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে ছাড়িয়া দেয়, তাহার মুখে কেমন করিয়া ফুটিয়া ওঠে সুখের হাসি – অবলার মনে আবারও সেই পুরানো প্রশ্ন জাগিয়া উঠিল ।

‘অবলা তুমি সুখ এবং আনন্দকে এক করিয়া ফেলিয়াছ। অথচ জান, এই দুই বিমূর্ত শব্দের মাঝে আছে এক সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা। তোমরা যাহাকে সুখ হিসাবে জান, যাহাকে ধরিবার জন্য আজীবন চেষ্টা করিয়া যাও, তাহা কিন্তু ধরিবার নয়। যাহা ক্ষণস্থায়ী যাহা তোমার অধীনে নয় তাহাকেই পাইবার জন্য তোমারা মরিয়া হইয়া উঠো। অর্থ-বিত্ত, প্রশংসা , সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা তোমায় হয়তো ক্ষণিক সুখ দেয়, হয়তো আনন্দের অনুভূতিও যোগায়, কিন্তু যখন তোমার ক্ষমতা চলিয়া যায়, তোমায় আর কেহ কারণে অকারণে সম্মান ও প্রশংসা করে না, তখন তুমি দুখী হও। কারণ সুখের মাঝেই নিহিত রহিয়াছে দুঃখের বীজ। তোমাদের সুখ বাহ্যিক অনুঘটক বা প্রভাবক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একথা তোমরা ভুলিয়া যাও। অবলা, জীবনের উদ্দেশ্য সুখী হওয়া নয়, আনন্দিত হওয়া। তুমি যদি আনন্দিত হও তাহা হইলে সুখ আপনি আপনি ধরা দেবে। আর এই আনন্দময় জগতের অংশীদার হইতে বাহ্যিক কোন অনুঘটকের প্রয়োজন হয় না, কারণ প্রকৃত আনন্দ উৎসারিত হয় তোমার হ্রদয়ের অন্তঃস্থল হইতে। আর একবার যে সেই আনন্দের খোঁজ পায়, তার শরীর মনে ছড়াইয়া পড়ে পরম প্রশান্তিবোধ। অবলা মনে রাখিও সুখ আনন্দ আনে না, এবং আনন্দ সুখের উপজাতও নয়। আনন্দ সুখের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আনন্দ হইল আত্মার ফসল, যাহা সুখের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী।

তুমি যে গৈরিক সন্ন্যাসীর কথা বলিলে সে কিন্তু সেই আনন্দেরই সন্ধান পাইয়াছে। প্রকৃত আনন্দ মানুষকে দেয় নিরুদ্বিগ্ন জীবন। তাইত তাহার চোখে মুখে এত স্বর্গীয় দ্যুতি। অবলা, তাই বলিয়া আনন্দকে খুঁজিয়া পাইতে তোমায় সবকিছু ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইতে হইবে – এ কথা ভাবিও না। আনন্দকে পাইতে হইলে তোমায় তোমার অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করিতে হইবে, নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে তোমার অবচেতন মন।’

একদল কাক সজনে গাছের ডালে বসিয়া কর্কশ সুরে কা-কা করিয়া ডাকিয়া গেল। বাড়ির বুড়ো ভৃত্য বারবার দরজায় আঘাত করিয়া শঙ্কিত কণ্ঠে বলিয়া গেল – বাবু দরোজা খোল, তোমার চিরতার জল। অবলা কিছুই শুনিতে পাইল না। জানালার ফাঁক গলাইয়া এক ফালি সূর্যের আলো অবলার কপাল ছুইয়া গেল। ভৃত্যের ডাকা ডাকিতে কিছু উৎসাহী প্রতিবেশী তাহার বন্ধ জানালা খুলিয়া ফেলিল। অবলা অর্ধ জাগরণের মাঝে তাহাদের কলরব শুনিতে পারিল। আস্তে আস্তে সে বুঝিতে পারিল আজ তাহার ঘুম ভাঙ্গিতে বড্ড বেশী দেরী হইয়া গিয়াছে। স্বপ্নের মাঝে সে যে মহাকালের পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে আস্তে আস্তে তাহার অনেক কিছু তাহার মনে পড়িয়া গেল। অবলা ধড়পড় করিয়া জাগিয়া উঠিল এক নতুন প্রভাতে …

চলবে…

 

।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন