ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

.. কি সেই প্রাপ্তি? তাকাইয়া দেখ তুমি নিজেই তাহার উত্তর পাইবে। অবলা অদূরে একদল গুহা মানব-মানবীকে এক বৃক্ষ ঘিরিয়া উদ্বাহু নৃত্য করিতে দেখিল। তাহারা উত্তেজিত হইয়া একে অপরকে কি জানি দেখাইতে লাগিল। মুখে তাহাদের উদ্দাম হাসি আর অবোধ্য কথামালা। অবলা কিছুই বুঝিতে পারিল না। বিবেক গাছে ঝুলিয়া থাকা আম্র বকুলের মতো দেখিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফুলের দিকে তাকাইয়া আবারও বলিতে শুরু করিল – অবলা, প্রাণী জগত যেমন তাহাদের জীবন চক্র পূর্ণ করে, উদ্ভিদ জগতও একি ভাবে জীবন চক্র পূর্ণ করে। এই জীবন চক্রে ফুলের উদ্ভাস এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফুল বিকশিত হইয়া এক জটিল প্রক্রিয়ার মাঝে ফলে পরিণত হয়। আর এই ফলের মাঝে বৃক্ষ লুকাইয়া রাখে তাহার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বীজ। প্রকৃতি কিন্তু এখানেই থামিয়া থাকে নাই – প্রকৃতি এই ফল আর বীজের মাঝে জমাইয়া রাখিয়াছে প্রোটিন, শর্করা, স্নেহজাতীয় পদার্থ সহ অসংখ্য প্রাণ রাসায়নিক, যাহা গ্রহণ করিয়া জীবজগৎ নানা ভাবে বিকশিত হইয়াছে, ওজনে বাড়িয়াছে, আকারে হইয়াছে বৃহদাকার । জান অবলা, আদিম গুহামানবেরা তাদের পূর্বজের কাছ হইতে শিখিয়াছে ফুল মানেই ফলের সম্ভবনা, অনাগত খাদ্যের উৎস। তাইতো ওঁদের মুখে প্রাপ্তির হাসি । প্রাচীন গুহা মানবেরা যুগ যুগান্তরের এই অর্জিত অভিজ্ঞান জীনে বাহিত হইয়া আধুনিক মানুষের মাঝে আজও টিকিয়া রহিয়াছে। আজ হয়তো মানুষ ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য গাছের পানে চাহিয়া থাকে না, কিন্তু ফুল যে ফলের পূর্বাভাস তাহা কিন্তু প্রকৃতি জীনের মাঝে লিখিয়া রাখিয়াছে। তাইতো আজও মানুষ ফুল দেখিয়া এতো আনন্দিত হয়।

গ্রীষ্মের প্রখর তাপে তৃষ্ণার্ত পথিক অদূরে মরীচিকা দেখিয়া আশার আলো খুঁজিয়া পায়, ক্ষুধার্ত ভিখারি অন্যের খাবারের পানে চাহিয়া থাকে, দরিদ্রকৃষ্ট মানুষ একটা লটারির টিকেট কিনিয়া স্বপ্ন দেখে, ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত নাবিকের চোখে যখন ভাসিয়া উঠে স্থলভূমির হালকা আভাস, তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটিয়া উঠে – এ সবই কিন্তু প্রাপ্তির প্রত্যাশা। এই প্রাপ্তির প্রত্যাশাই কিন্তু মানুষকে দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেতে সাহায্য করে।

একবার ভাবিয়া দেখ – জীবনের দুর্গম পথে চলিতে যাইয়া যদি সমস্ত আশার আলো নিভিয়া যায় – তাহা হইলে কি মানুষ দুর্গম গিরি পার হইতে পারিত? পারিত না। প্রাণীকুল যুগ যুগান্তরের প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জন করিয়াছে এই ধনাত্মক অনুভূতি। জান কে জাগাইয়া তোলে এই ধনাত্মক অনুভূতি! তোমার মস্তিষ্ক, তোমার মস্তিস্কের বিশেষ অংশের এক জটিল neural pathway যাহাকে বিজ্ঞানীরা বলে ডোপামিন প্যাথওয়ে। মস্তিষ্ক যখনি কোন প্রাপ্তির সম্ভবনা দেখে, neural pathway নিঃসরণ করে আশাপ্রদায়ী, সুখানুভূতি জাগানিয়া নিউরোকেমিক্যাল ডোপামিন। এই ডোপামিন হইলো প্রকৃতির এক বিশেষ পুরস্কার। তাইতো মস্তিষ্কের এই বিশেষ সিস্টেমকে বিজ্ঞানীরা নাম রাখিয়াছে Brain rewarding system

অবলা স্তম্ভিত হইলো, বিভ্রান্ত হইলো। মনে প্রশ্ন জাগিল সুখ ও আনন্দের বসবাস যদি প্রাপ্তির মাঝেই হইয়া থাকে তাহা হইলে ত্যাগের গরিমা কি তুচ্ছ? ত্যাগের মাঝে কি কোনই আনন্দ নাই, নাই কোন সুখ? অবলার মনে পড়িল তাহার মায়ের কথা। গরীব অসহায় পথের ভিখারিকে খাদ্য দিয়া, বস্ত্র দিয়া সাহায্য করিতে পারিলে তাহার মুখে ছড়াইয়া পড়িত ঐশ্বরিক আনন্দের ছটা। তাহার পিতা অনেকের আপত্তি স্বত্বেও বিদ্যালয় গড়িতে এক বিশাল ভূসম্পত্তি দান করিয়াছিলেন। কৈ তিনি তো কক্ষনো তাহার জন্য কোন অনুশোচনা করেন নাই!

অবলার অন্তরাত্মার সংশয় অনুধাবন করিতে পারিয়া বিবেক আবারও জাগ্রত হইলো – অবলা, তোমার মনের যে সংশয় তাহা কিন্তু অমূলক নয়। বিদ্যাসাগর অকাতরে মানুষকে সাহায্য করিতেন, কেউ ভিক্ষা চাহিলে মধুসূদন পকেটে যাহা থাকিত সবটুকু উজাড় করিয়া দান করিয়া দিতেন। দানবীর হাজী মোহাম্মদ মুহসীনের কথা কে না জানে? আধুনিক বিশ্বে বিল গেটস, ওয়ারেন ব্যাফেট , জামসেতজী টাটা তাহাদের অর্জিত অর্থের এক সিংহ ভাগ ব্যয় করিয়া চলিয়াছেন মানব কল্যাণে। আপাত দৃষ্টিতে তাহাদের এই ত্যাগ নিঃস্বার্থ মনে হইলেও আসলেই কি কোন প্রাপ্তি নাই? তাহাদের এই ত্যাগ তাহাদের ঝুলিতে জমা করিয়াছে মানুষের অফুরন্ত ভালবাসা, অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ। অবলা, জগতে নিঃস্বার্থ বলিয়া কিন্তু কিছু নাই।

প্রাপ্তির মাঝে যেমন সুখানুভূতি, দানের মাঝে তার চেয়েও অধিক সুখানুভূতি, অধিক আনন্দ নিহিত রহিয়াছে। যখন তুমি কোন কিছু অর্জন কর, সেই অর্জনকে ধরিয়া রাখিতে তোমায় নিরন্তর পরিশ্রম করিয়া যাইতে হয়। যখন তুমি কারো কাছ হইতে কোন কিছু গ্রহণ কর, তাহাতে এক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। এই দায়বদ্ধতা, এই প্রাপ্তি তোমার মনে বিশাল এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। মানুষ অনেকক্ষেত্রে এই চাপ হইতে নিষ্কৃতি পাইতে দান করে। আবার সমাজের অপরাধী বিবেকের দংশনে দংশিত হইয়াও দান করে। আবার কেহ দান করে নিজকে দশ জনের মাঝে এগারতম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ দান করিয়া, ত্যাগ করিয়া মানসিক চাপ হইতে নিষ্কৃতি পায় আর পাশাপাশি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে গড়িয়া তোলে সামাজিক সম্পর্কের এক শক্তিশালী বন্ধন। প্রকৃতি মানুষকে সামাজিক করিবার প্রয়াসেই কিন্তু দানের মাঝে এমন সুখানুভূতি প্রদান করিয়াছে। দান আর প্রাপ্তি উভয় ক্ষেত্রেই মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে। নিঃসরিত ডোপামিন মনে ছড়াইয়া দেয় নির্মল সুখানুভূতি …

।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

চলবে…

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন