Uncategorized ফিচার্ড

রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ের রেজা যেভাবে আমেরিকার বন্ধু হলেন

রেজাউল করিম রেজা

রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ের রেজা যেভাবে আমেরিকার বন্ধু হলেন

ভয়েস অব আমেরিকা দিয়ে শুরু। তারপর আরও সূত্র যোগ করে ইংরেজিতে সমৃদ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের রেজাউল করিম রেজা। রংপুরের নিজকবিলপুর খেয়াপাড়া গ্রামের রেজাউল এখন ইংরেজির একজন শিক্ষক এবং ফ্রিল্যান্সার। আস্তে আস্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার বন্ধুত্ব। ভয়েস অব আমেরিকা, মার্কিনিরা তাকে যেসব বইপত্র পাঠিয়েছে- তা সুন্দর করে নিজের পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি। ২রা জুলাই তার লেখা এ সম্পর্কিত  প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে অনলাইন ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে।

এতে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছি আমেরিকা।

২০০১ সালের আগে আমেরিকা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না আমি। ওই বছর ৯/১১ তে তোমাকে কাঁদিয়ে গেছে। এতে পাল্টে গেছে পুরো বিশ্ব। ২০ বছর পরে, যখন তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি তখন তোমাকে, তোমার জনগণ এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমি জানি।

রেজা আরো লিখেছেন, আমি যখন জুনিয়র স্কুলে পড়ি তখনই প্রথম আমেরিকার কথা প্রথম শুনতে পাই। আমাদের ভূগোলের শিক্ষক বিশ্ব মানচিত্র দেখাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তার আঙ্গুল গিয়ে থামে একটি রেখা বরাবর। সেখানে লেখা ছিল ইউএসএ। তিনি আমাদেরকে বললেন, এটাই আমেরিকা। বিশেষ করে আমেরিকার কথা কেন আমার শিক্ষক উল্লেখ করেছিলেন সে সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলাম আমরা। কিন্তু তিনি আর ব্যাখ্যা করেন নি।

২০০১ সালে ১০ম শ্রেণির পড়া শেষ করি। এ সময়েই আমাদের গ্রামের একটি সাদাকালো টেলিভিশনে ৯/১১ এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করি। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবার আমি আমেরিকা দেখি। যখন ধোয়ার কুণ্ডলি আকাশে উড়ে যাচ্ছিল আর টাওয়ার দুটি ধসে পড়ছিল, তখন আমি মার্কিনিদের দেখেছি। এটাই প্রথম তাদেরকে কথা বলতে শুনেছি। তাদের কথা শুনে আমারও তাদের মতো কথা বলতে ইচ্ছে হলো। তাই আমি ইংরেজি শেখা শুরু করি।

রেজা লিখেছেন, সরকারি টেলিভিশন ছাড়া আমাদের আর কোনো স্যাটেলাইট চেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। আমাদের কোনো পাকা রাস্তা বা বিদ্যুত ছিল না। আর তো ইন্টারনেট! তাই ইংরেজি শেখাটা ছিল খুব কঠিন। আমার এক চাচার কাছে একটি রেডিও সেট পাওয়ার পর আমি ইংরেজিতে খবর প্রচার করে এমন চ্যানেল খুঁজতে লাগলাম। এভাবেই আমি আবিষ্কার করে ফেলি ভয়েস অব আমেরিকা। ভয়েস অব আমেরিকার ‘লার্নিং ইংলিশ’ প্রোগ্রাম শুনে, আমার ইংরেজির মান কিছুটা উন্নত হয়।

এ অবস্থায় কিছু বই চেয়ে আমি ভয়েস অব আমেরিকার কাছে চিঠি লেখি। তারা আমাকে কিছু বই, ম্যাগাজিন এবং ওয়াশিংটন ডিসির সুন্দর একটি ছবি পাঠালো। কিছু গ্রামার বই কিনলাম। বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার পত্রিকা পড়া শুরু করলাম। আমার ইংরেজির দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমি আমেরিকা এবং তার জনগণ সম্পর্কে জানা শুরু করলাম।

২০১০ সালে আমাদের গ্রামে বিদ্যুত এলো। এলো রঙিন টিভি সেট। তাতে বহুমাত্রিক চ্যানেল। একটি স্মার্টফোন কিনলাম এবং স্থানীয় একটি ফোন কোম্পানির ইন্টারনেট সেবার সঙ্গে যুক্ত হলাম। ফেসবুকে একাউন্ট খুলে মার্কিনিদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলাম। যদিও তাদের বেশির ভাগই সাড়া দেননি, তবু তাদের কেউ কেউ বন্ধুপ্রতীম ছিলেন এবং সাড়া দিলেন। এর মধ্যে রয়েছেন ভার্জিনিয়ার একজন।

রেজা লিখেছেন, আমার ওই ভার্জিনিয়ার বন্ধু ও তার মিষ্টিমনের স্ত্রী আমাকে অনেক বই ও কিছু উপহার পাঠালেন। এসব উপহার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সাহিত্য সম্পর্কে। আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ওইসব বই। ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে। আমাকে যেসব বই পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে বিখ্যাত সব মার্কিন লেখকের বই আছে। এর মধ্যে আছেন ওয়াশিংটন আরভিং, জন স্টেইনবেক। যখন ‘দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ’ পড়ছিলাম মনে হচ্ছিল আমি জোয়াড পরিবারের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার ভিতর দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি। মহামন্দা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আমার তালিকায় আরো একটি শিক্ষা যুক্ত হলো এ থেকে। এরই মধ্যে ইতিহাস সম্পর্কে যা শিখেছি, তা নিয়ে কিছু লেখা ফেসবুকে একটি গ্রুপের সঙ্গে শেয়ার করলাম। তা আরো মার্কিনির কাছে পৌঁছে গেল।

ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে টেক্সাসে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হতে থাকে। আলামো’তে টেক্সাস-মেক্সিকো যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি আমাকে জানালেন। তিনি আমাকে যেসব ছবি পাঠিয়েছেন তা দিয়ে আমি টেক্সাসের সব কিছু সম্পর্কে জানতে পারলাম। প্রায়দিন আমাদের আলোচনায় থাকতো রোডিওস, র‌্যাঙ্কোস, র‌্যাটলস্নেকস। তিনি আমাকে আরো পাঠিয়েছেন বই, কলম এবং লেখার কাগজ। এসব বই থেকে আমি কাউবয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আরো জানতে পেরেছি। যখনই ওইসব রঙিন কলম হাতে নিই, তখনই আমার মধ্যে নিজস্ব মার্কিনি একটি স্বপ্ন জেগে ওঠে। পড়াশোনার সময়, শিক্ষা দেয়ার সময় এবং গল্প লেখার সময় আমার ভিতর জেগে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর ভার্চ্যুয়ালি আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় ছুটে যাই, যেখানে আমি আমার প্রথম বন্ধুর সাক্ষাৎ পাই। মহামন্দার সময় আশ্রয়গ্রহণকারী স্প্যানিশ থেকে শুরু করে অভিবাসী- যারা সেখানে বসবাস করতেন, আমার ক্যালিফোর্নিয়ার বন্ধু আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস বললেন। আমাদের আলোচনার মধ্যে, আমি এক উদ্ভট আমেরিকা আবিষ্কার করলাম, যা বাংলাদেশ থেকে অনেক অনেক দূরে। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন জায়ান্ট ফরেস্টের সঙ্গে, ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, ক্যালিফোর্নিয়া কোয়েল, সূর্য্য আর সমুদ্র সৈকতের সার্ফ সম্পর্কে।

আমি থামছি না। আরো মার্কিনি সম্পর্কে জানতে চাই। তাদের একজন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন। আমার এই সেনাবন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে- ভ্যাটিক্যান যুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট সহ অনেক বিষয়ে। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইরাকে। তিনি দেশের জন্য কিভাবে যুদ্ধ করেছিলেন সেইসব অভিজ্ঞতা শুনলাম। এটা শুনে মনে হলো, একজন সেনার জীবন কতটা কঠিন।

যদি যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে আজকের এই আমি হতাম না। এখন আমি আমার ছোট্ট গ্রামে বসে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দামতার সঙ্গে মিশে যেতে পারি। বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়াতে পারি। কেন স্থানীয় মার্কিনিদের ইন্ডিয়ান বলা হয় তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যুক্তিতর্ক করতে পারি। এখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের গণঅধিকার আন্দোলনে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ভূমিকা সম্পর্কে আমার অনুধাবন অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি।

যেসব মার্কিনি এই যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্তরাষ্ট্র বানিয়েছেন তাদের সবার প্রতি ধন্যবাদ। এই যুক্তরাষ্ট্র হলো তার জনগণ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস। আমার কাছে বাংলাদেশে এটাই হলো আমেরিকা। বন্ধুদের অনেক ধন্যবাদ জানাই। শুভ জন্মদিন আমেরিকা।

-মানবজমিন


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন