ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ১৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

জনারণ্যে রটিয়া গেল অবলা দেহ ত্যাগ করিয়াছে। শব্দের গতির চেয়েও দ্রুত গতিতে সেই জনশ্রুতি ডালপালা মেলিয়া ছড়াইয়া পড়িল পথে প্রান্তরে। কেহ বলিল একাকীত্বের চরম হতাশায় অবলা আত্মহত্যার পথ বাছিয়া লইয়াছে, কেহ বলিল হৃৎস্পন্দনের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া অবলার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটিয়াছে । আবার সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত কেহ কেহ তাহার মৃত্যুর মাঝে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইল। একদল উৎসাহী মানুষ সেই সন্দেহকে আরেক ধাপ আগাইয়া লইয়া গেল। অবলার বিশাল সম্পত্তির উপর অনেকেরই চোখ। হয়তো কেউ তাহার খাবার মাঝে বিষ মিশাইয়া দিয়াছে। তাহাদের চোখ পড়িল অবলার বিশ্বস্ত ভৃত্য কালীচরণের প্রতি। তাহারা বৃদ্ধকে ঘিরিয়া ধরিয়া প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করিতে লাগিল। অপমানিত লাঞ্ছিত কালীচরণ হাত জোড় করিয়া কাঁদিতে লাগিল। ‘আমি সত্যি কিছু জানি না, বাবু প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণ শেষ করিয়া বৈঠক খানায় বসিয়া থাকেন। আজ উনাকে না দেখিতে পাইয়া আমি তাহার দরজায় বারবার করাঘাত করিয়াছি কিন্তু উনি দরজা খোলেন নাই; দরজা ভেতর হইতে বন্ধ। এর বাহিরে আমি কিছুই জানি না।’ কেহ তাহার কথায় মৃদু বিশ্বাস করিল, কেহ তাহাকে সজোরে ঠেলিয়া দিয়া অবলার শয়নকক্ষের দিকে ছুটিয়া গেল। কেহ বলিল দরজা ভাঙিয়া ফেল, কেহ বলিল শীঘ্র অবলার ছেলেমেয়েদের কাছে খবর পৌছিয়া দাও…

বাড়ীর বাহিরে অসংখ্য মানুষের কোলাহল শুনিতে পাইয়া অবলা সশব্দে দরোজা খুলিয়া ফেলিল। অনেকে তাল সামলাইতে না পারিয়া তাহার ঘরের মাঝে ঢুকিয়া পড়িল। অবলা এত মানুষের এমন হুড়াহুড়িতে প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করিতে লাগিল। অদূরে ছিন্নবস্ত্র, ক্রন্দনরত কালিচরণকে দেখিতে পাইয়া অবলা কাছে ডাকিল। খর্বকায় কালীচরণ অপমানে অভিমানে আরও খর্বকায় হইয়া গিয়াছে। এই দরিদ্র মানুষটি তাহার জীবনের চেয়ে অধিক মূল্যবান আত্মসম্মানকে হারাইয়া ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে অবলার বুকে আছড়াইয়া পড়িল। বারংবার বলিতে লাগিল – বাবু আমি তোমার খাবার মাঝে বিষ মিশাইয়া দিয়া তোমায় মারিয়া ফেলিব – কস্মিন কালেও ভাবিতে পারিনা! যে আমাকে রাস্তা হইতে কুড়াইয়া আনিয়া বাগানের এক নিভৃত কোনে মাথা গোজার ঠাই করিয়া দিয়াছে তাহার সম্পর্কে এমন কথা শুনাও পাপ ! অবলা কালীচরণের চোখের জল মুছাইয়া দিয়া গর্জিয়া উঠিল – বল কে বলিয়াছে? কালীচরণ সাত পাঁচ ভাবিয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিল। ঘরের মাঝে ঢুকিয়া পড়া লোকজন ভুত দেখার মতো ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া মাথা নিচু করিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গেল।

বাহিরে তখনও ভীর। আমগাছের ছায়ায় বসিয়া থাকা কতিপয় বকাটে ছেলে অতিশয় মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া উঠিয়া পড়িল। অবলার আকস্মিক প্রত্যাবর্তন তাহাদের আনন্দে যেন বিঘ্ন ঘটাইল ! খেলা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় যাঁহারা তামাসা দেখিতে আসিয়াছিল তাহাদের মেলা ভাঙিয়া গেল। ভীর হইতে কয়েকজন বন্ধু ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার দীর্ঘজীবন কামনা করিল। অবলা অবাক হইয়া মুখে কিঞ্চিত হাসি আনিয়া বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলিল – আমার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা আমি নিজেই জানিতে পারিলাম না। সত্যিকারের মৃত্যু আসিলে তোদের জানাইয়া তবেই মরিব…।

আস্তে আস্তে ভীর ক্ষীণ হইয়া আসিল। অবলা একটা চেয়ার টানিয়া বারান্দায় বসিল। কালীচরণ তাহাকে চা দিয়া তাহারী পায়ের কাছে কাঁচুমাচু হইয়া বসিয়া রহিল। অবলা স্নেহভরে তাহার মাথায় হাত রাখিতেই আবারো সে সর্বহারার মতো কাঁদিতে লাগিল। ‘আমার যে তিন কুলে কেহ নাই। তুমি সেই কোন কালে অনাথ আশ্রম হইতে আমায় তোমার গৃহে স্থান দিয়াছ। সেই ছোট বেলায় কবে অনাথ হইয়াছিলাম তাহা মনে নাই। আজ আবারও অনাথ হইবার ভয় আমাকে তাড়া করিয়াছে। বাবু তুমি চলিয়া গেলে আমায়ও লইয়া যাইও’। অবলা স্নেহবৎশল কালীচরণের পানে এক দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল। যখন সবাই তাহাকে ছাড়িয়া গিয়াছে, তখন ঐতো তাহার সেবা করিয়াছে। কোন গালমন্দ গায়ে মাখে নাই। তাহাকে সেবা করিতে করিতে কখন যে কালীচরণ বার্ধক্যের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, এতো দিন সে বুঝিতে পারে নাই। অবলা বিবেকের দংশনে দংশিত হইলো। তাইতো, ঐ বাগান বাড়ীর জীর্ণ ঘরখানায় ও কেমন করিয়া রাত্রি কাটায় – সে একবারেও ভাবিয়া দেখে নাই। স্বার্থপরের মতো নিজে একাকী হইয়া তাহাকেও একাকীত্বের দিকে আগাইয়া দিয়াছে। তাইতো, সে চলিয়া গেলে কালীচরণের কী হইবে? কালীচরণের ম্লান মুখখানি পরখ করিয়া সে তাহার উত্তর পাইল। অবলা কালীচরণকে আরও কাছে ডাকিল। জিজ্ঞেস করিল – কালীচরণ, তোর কি অন্যকোন জামাকাপড় নাই, পায়ের স্যান্ডেল, লুঙ্গি? কালীচরন অপ্রতিভ হইয়া মাথা নিচু করিয়া বসিয়া রইল। অবলা মনে মনে ভাবিল – আজি সে ওর জন্য নতুন জামা কাপড় আনাইয়া লইবে। তার ঘরটি বসবাসের উপযুক্ত করিয়া দিবে, আর ওর জন্য একটা ভাল লক্ষীমেয়ের খোঁজ করিবে। মনের কথা মনের বাহিরে চলিয়া আসিল। কালীচরণ বাবুর মুখে অমন কথা শুনিতে পাইয়া লজ্জাবনত হইয়া উঠিয়া গেল।

অবলা অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিল – আজ তাহার যেন পুনর্জন্ম হইলো! এমনি করিয়া ঘুমের মাঝে, স্বপ্নের মাঝে তাহার যদি এমন কষ্টহীন মৃত্যু আসে তাহাকে সে আনন্দভরে আলিঙ্গন করিবে। তাহার মৃত্যুর পর হয়তো এমনি করিয়া মানুষের ভীর হইবে। হোক সে নিছক কৌতূহল, তবুও তো মানুষের ভীর – তাহাকে একনজর দেখার জন্য। তাহার মৃত্যুতে কালীচরণের মতো, তাহাকে জড়াইয়া ধরা বন্ধুদের মতো তাহার অনেক প্রিয়জন আসিবে। কেহ কাঁদিবে, কেহ চিৎকার করিয়া বলিবে – তোমায় যাইতে দিব না। কে বলিবে এমন কথা – যেতে নাহি দেব? মনের মাঝে বহুদূর তাকাইয়া কালীচরণ ছাড়া সে কাহারো দেখা পাইল না । যখন সে শুনিতে পাইল তাহারী ছোট ছেলে তাহার মৃত্যু সংবাদে বিচলিত হইয়া যাত্রা করিয়া অর্ধেক পথে বাড়ী ফিরিয়া গিয়াছে, তীব্র মনকষ্টে সে বিদ্ধ হইয়াছে। মনে তাহার প্রশ্ন – তাহার যে মৃত্যু হয় নাই তাহাতে কি ওরা ব্যথিত হইয়াছে? ওরা কি শুধু সম্পত্তির ভাগ নিতেই এতো কষ্ট করিয়া আসিয়া ফিরিয়া গেল ! অবলার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। যতই সে ভাবে এসব কথা ভাবিবে না, তবুও কেন যেন কোথা হইতে ক্ষতগুলো বুদ্বুদের মতো উঠিয়া আসিয়া চোখে অশ্রু ঝরায় !

অবলা চোখ মুছিয়া আকাশের পানে চাহিল। আষাঢ়ের আকাশ তাহারই মতো ঘন মেঘে ঢাকা। তাহার মনের মাঝে উঠিয়া আসা হতাশার স্মৃতিগুলোর মতো অসংখ্য ছোট বড় মেঘ তাহারই বুক চিড়িয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। হঠাৎ করিয়া মেঘ গর্জন করিয়া জলের বড় বড় ফোটা লইয়া অবলার দিকে ছুটিয়া আসিল। অবলা বিড়বিড় করিয়া বলিয়া চলিল – মেঘমালা, তোমার বুকে কতো গর্জন, কতো অভিমান, কতো জল! তুমি আমার সবটুকু ক্রন্দন, সবটুকু হতাশা গ্রহণ করিয়া আমায় ভারমুক্ত কর। বৃষ্টিমুখর প্রকৃতি তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিল। মেঘেরা তাহার সর্বাঙ্গ শীতল জলধারায় শিক্ত করিল। আরও প্রখর হইলো বৃষ্টির ধারা। মস্তিষ্কের কোন এক বন্ধী কামরা হইতে কোন সুদূর অতীতের ভাল লাগা কিছু কথা শব্দের মালা গাথিল। অবলার মুখ নিঃসৃত সে কথামালা আকাশের সাথে মিতালী করিয়া সুর তুলিয়া অবিশ্রাম ধারায় ঝড়িয়া পড়িল –

‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে–
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।
রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে
নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ,
এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান,
নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে।
আবার আষাঢ় এসেছে আকাশ ছেয়ে।’ – রবী ঠাকুর

চলবে…

। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন