ফিচার্ড লেখালেখি

প্রসঙ্গঃ বিশ্বায়িত করোনা ভাইরাস: || জয়িতা চট্টোপাধ্যায়

প্রসঙ্গঃ বিশ্বায়িত করোনা ভাইরাস: || জয়িতা চট্টোপাধ্যায়

এ এক অদ্ভুত সময়, সন্দেহ দানা বেঁধে আছে বুকের খাঁচায়। একজন আরেকজনের থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে , ভাবছে কি জানি করোনা হয়নি তো? আর যে অঞ্চলে করোনা ধরা পড়ছে সে অঞ্চলে ভয়ে পা বাড়াচ্ছে না কেউ। আঁতকে উঠছে লোকে সে পাড়ায় যেতে। অথচ, বাজার হাট কেনাকাটা দিব্য চলছে।

কাজের মাসিকে ছাড়িয়ে দেওয়া হল মার্চ মাসে অথচ দুধওয়ালা বেশ তো আসছে তখন? সংক্রমণ খবরের কাগজ থেকেও ছড়াতে পারে তাই তা বন্ধ। আর প্রতিবেশীর সামান্য জ্বর জ্বালা হলে কোথা থেকে যেনো দৈববাণী চলে আসছে ‘ অমুক বাড়িতে করোনা সুতরাং, সেখানে যাওয়াও বন্ধ। আর যে সমস্ত দিনমজুর দুপুর হলেই কাজ সেরে টিফিন বাটি খুলে গাছের তলায় নিশ্চিন্ত মনে ভাত খায়, কই তাদের মনে তো ভয় ধরাতে পারেনি করোনা জুজু। এদের সাথে তো দূর দূর পর্যন্ত স্যানিটাইজার, হান্ডওয়াশ এই শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। আর কাজের সময় মুখে মাস্ক ও নেই, শুধু পুলিশ যদি ধরে সেই ভয়ে গামছাটা সম্বল করে পাশ কাটাচ্ছে। করোনা তো প্রায় ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে জলে, জঙ্গলে, বাতাসে সর্বত্রই নাকি করোনা। তাহলে জল খাবোনা? আশ্চর্য এক ভয়ের বাতাবরণ কিন্তু এই ভয়ের পরিবেশ তৈরী করার পেছনে অদৃশ্য হাত কার? এক নিঃশব্দ সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে, বন্দী হয়ে আছি নিজেরই ঘরে। এ শেকল বড় কঠিন ছেঁড়ার চেষ্টা করেছ তো আক্রমণ আসন্ন। মাস্ক না পড়লে আসবে হুমকি ঘরের ভেতরেও  বাইরেও। তার চেয়ে থেকে যাও ঘরে চুপচাপ। করোনা তো ঈশ্বর তার বিত্ততার বৈভব জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বদা।

যে ভাইরাসের বৈভব এত তীব্র সেই ভাইরাস এলেন কোথা থেকে না জানলে তো ঈশ্বর ও পাপ দেবেন। যেমন শিবের উপাসনা করতে হলে আমরা জানতে পারি তিনি কৈলাশপতি, তেমন ই চীনের উহানের উপকন্ঠে এক গ্রামে ৪৪ বছরের ওয়াং ফেই মারা গেলেন কোভিড ওয়ার্ডে। তখন ও পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছিলেন সরকারি ভাবে তিনজন। ধীরে ধীরে চীন সহ গোটা বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। এখন এই ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি অবরুদ্ধ , অর্থনৈতিক ধ্বস নেমেছে বিশ্বজুড়ে।

কিন্তু বিষয় হলো এই ভাইরাসের উৎপত্তি কোথায়? কী ভাবে এই ভাইরাসের উৎপত্তি? এই ভাইরাসটি প্যাথোজেন পরিবারের তার নাম করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাসের কারণে সার্স ও মার্স ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছিল। সার্সে আক্রান্তদের ৯% এবং মার্সে আক্রান্তদের ৩৫% মারা গেছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা যে ধরনের করোনা ভাইরাস থেকে সার্স ও মার্সের জন্ম হয়েছিল এবং যে নতুন করে ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে সেগুলির কোনোটিরই উৎস মানুষ থেকে হয়নি। বরং, এসবের জন্ম হয়েছে মানুষ ব্যতীত প্রাণী থেকে। অনেক প্রাণী শরীরে বিপদজনক ভাইরাস বহন করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সকল ভাইরাস একলাফে মানুষের শরীরে বংশবিস্তার করতে পারেনা। ওয়ারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যান্ডুইস্ট বলেন “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি বাধা আছে এবং ভাইরাসটি সেই বাধা অতিক্রম করতে

পারেনা।” “তবে কখনো কখনো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি দুর্বল থাকে তখন ভাইরাসটি প্রাণী থেকে মানুষের শরীরেও চলে আসতে পারে।” আর এটি ঘটে ভাইরাসটির স্থান পরিবর্তনের ও জিন গঠিত রূপান্তরের মাধ্যমে। তার মানে হল প্রাণীদেহে ওই ভাইরাসটির জিনগত গঠন যেমন ছিল , মানুষের শরীরে এসে সেই গঠনটিকে পরিবর্তন করতে হয় , আশ্রয় নেওয়ার জন্য। নতুন পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্যই মূলত ভাইরাসটিকে নিজের গঠনে এই পরিবর্তন আনতে হয়।

তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই ঘটনা বিরল তবে এই প্রক্রিয়ায় করোনা ভাইরাস যখন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তখন সেটা খুবই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সব ধরনের করোনা ভাইরাস অতটা যদিও বিপজ্জনক নয়। কিন্তু যেসব ভাইরাস পশুপাখি থেকে মানুষে চলে আসে বা আসতে পারে সেগুলো খুবই বিপদজনক।

প্রফেসর ইস্টনের কথায় যখন একটি ভাইরাস এক প্রজাতির থেকে আরেক প্রজাতিতে চলে যায় তখন আগে থেকে ধারণা করা যায়না যে ঠিক কী ধরনের কাণ্ড ঘটাবে। তবে এটি তার নতুন আবাসস্থলে গিয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই মারাত্মক রূপ নিতে পারে। “আর এটি হওয়ার কারণ হল যখন ভাইরাসটি কোনও প্রাণী থেকে হঠাৎ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তখন মানুষটির রোগপ্রতিরোধ কারী ব্যবস্থা তাকে চিনতে পারে না। কারণ এই ভাইরাস মোকাবিলায় মানবদেহের পূর্ব কোনও অভিজ্ঞতা নেই। যার ফলে ভাইরাসটির কারণে মানুষের জীবন এক ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

করোনা ঠেকাতে মানুষ কি হারাচ্ছে , তার মনুষ্যত্ব? একেই টেকনোলজির আধুনিকতার যুগে মানুষ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন , এর মধ্যে নতুন এক অপপ্রয়াস চলছে করোনা নামের যা মানুষকে মনুষ্যত্বহীন করে তুলেছে। যদিও আমি আগেই বিস্তারিত ভাবে করোনা ভাইরাস নিয়ে বলেছি , তার একটিই কারণ – করোনা সম্মন্ধে মানুষের কোনো সুস্পষ্ট ধারনা নেই। কেবল গুজবের মাধ্যমে একটা রোগ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলো মানব সমাজে , সঙ্গে মিডিয়ার প্রচার নাকি অপপ্রচার। সে যাই হোক ভয়ে ভয়ে কুঁকড়ে আছি আমরা সকলে।

২০১৯-২০২০ করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারী চলমান সমাজকে , অর্থনীতিকে , ধ্বংসের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। রোগটির প্রাদুর্ভাব প্রথমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে সনাক্ত করা হয়।

২০২০ সালের ১১ ই মার্চ তারিখে বিশ্ব সংস্থা রোগটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।২০২০ সালের ২৮ শে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৮৫ টিরও বেশী দেশের অধিনস্ত অঞ্চলে ৩০ লক্ষেরও বেশী ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে প্রকাশ পেয়েছিল।

গত আটমাস ধরে মানুষের মধ্যে এক অন্য ধরনের ভয় জাঁকিয়ে বসেছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়। আচ্ছা লকডাউনে পেশহীনতার ভয় কেউ পাচ্ছে না কেন? অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়ে সাধারণ মানুষ যতটা ভীত তারচেয়ে অনেক বেশী তারা ভীত এই ভেবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাবো না তো? আক্রান্ত হলে কি হবে? চিকিৎসা কিভাবে হবে? পরিবারের কি অবস্থা হবে? সবমিলিয়ে মানুষের মনের মধ্যে এক প্যানিক অ্যাটাকের সৃষ্টি হয়েছে।

কিছু মানুষ এমন আছেন যারা কিছুতেই নিজের ঘরের বাইরে বেরোতে পারছেন না , নিজের হাত ধোয়া বারংবার আটকাতে পারছেন না। তাদের বারবারই মনে হচ্ছে জীবাণু তার হাতে লেগে আছে আর তার থেকেই তার পরিবার সংক্রমিত হতে পারে। এমনটাতো আগে মানুষের মধ্যে হয়নি, কিন্তু লকডাউনে কলেজ , স্কুল, অফিস সব বন্ধ। বাইরে পা দেওয়াও প্রায় বন্ধ। প্রতিদিন বাড়তে থাকা সংক্রমণের খবর মানুষের মনে ভীষন একভীতির সঞ্চার করছে।

এই ধরনের সমস্যাগুলোকে OCD বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বলে। কোভিডকে ঘিরে যে মানসিক সমস্যা গুলি বেড়ে চলেছে তারমধ্যে প্রধান কিছু সমস্যা হলো মাত্রাধিক উদ্বেগ বা anxiety , ডিপ্রেশন বা অবসাদ , ওসিডি ইত্যাদি। হাজার হাজার তরুণীর কান্নার শব্দ গুঞ্জরিত হচ্ছে সবার অলক্ষে। কত মানুষ হয়ে পড়েছে জীবিকাহীন। কর্মহীন অবস্থায় বেড়েছে মদের নেশা তেমনি বেড়েছে স্ত্রী , সন্তানের ওপর অত্যাচার। এটাই হল গত সাত – আট মাসের হাজার পরিবারের পরিচিত দৃশ্য।

ভারতে কোভিড অতিমারীর ঘটনাটি প্রত্যক্ষ হয় ২০২০ সালের ৩০ শে জানুয়ারী , ২১ শে সেপ্টেম্বর ২০২০ অনুসারে মোট সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ৫৪,৮৭,৫৮০ জন যার মধ্যে ৮৭,৮৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারতে কোভিড ১৯ এর মৃত্যুর হার ২১ শে সেপ্টেম্বর ২০২০ অনুসারে ১.৬% , ভারতে কোভিড – ১৯ পরীক্ষা অনুসারে প্রতি ১০ লক্ষে ৪৭,৫৯২.৪৬ জন অপ্রতিসম।

দিল্লী,হরিয়ানা,কর্ণাটক,মহারাষ্ট্রে,গুজরাট এবং উত্তর প্রদেশ, এরকম এক ডজনেরও বেশী রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মহামারীর কবলে। মহামারী রোগ আইন ১৮৯৭, এই প্রাদুর্ভাব আটকানোর লক্ষে সারা ভারত জুড়ে কার্যকর করা হয়েছে। তবে ছোটো করে জানিয়ে রাখি এই মহামারী রোগ আইন ১৮৯৭, একটি আইন যা মুম্বাইয়ের(পূর্ব মুম্বাই) ব্রিটিশ ভারতে বিউবনিক প্লেগ মোকাবিলায় প্রথম লাগু করা হয়েছিল। আইনটি মহামারী রোধের জন্য বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে যা রোগের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্যবহৃত হয়।

মহারাষ্ট্র তথা মুম্বাইয়ে মহামারী বা অতিমারীর আগমন নতুন নয়। ১৮৯১ খ্রি: সাবেক বম্বের জনসংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ ২০ হাজার। রোগের প্রকোপে বহুমানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। মৃত্যু এবং আতঙ্কিত শহরবাসীর পালিয়ে যাওয়ায় দুই মিলিয়ে দ্রুত হারে কমে যায় তৎকালীন বম্বের জনসংখ্যা। এটি ছিল তৃতীয় রোগ মহামারী। তৃতীয় এই হিসাবটি অবশ্য নিতান্তই ইউরোপীয়। খ্রি: ষষ্ঠ শতকের প্লেগ অফ জস্তিনিয়ান , চতুর্দশ শতকের ব্ল্যাক ডেথের পর উনিশ শতকে ফের অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছিল ইউরোপ। তাই এর নাম তৃতীয় প্লেগ অতিমারী।

এই অতিমারীটির ও উৎস চীনে। অনেকের মতে সেখান থেকেই বাণিজ্য জাহাজের সংক্রমিত ইঁদুরের মাধ্যমে তা পৌঁছায় বোম্বে বন্দরে। এই প্লেগ ভারতে পৌঁছেছিল ১৮৯৬ সালে। তখন থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে শুধু প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন অন্তত এক কোটি মানুষ। রোগ সংক্রমণের প্রথম বছরে তৎকালীন বোম্বে শহরে মানুষের মৃত্যুর হার ছিল সপ্তাহে ১,৯০০। পরে তা ছড়ায় কোলকাতা , করাচি ও অন্যত্র। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললে চলে না – ভারত বাদে দুনিয়ার সব দেশ মিলিয়ে এই প্লেগে মৃত্যু হয়েছিল ত্রিশ লক্ষ মানুষের।

বাণিজ্য পথ বন্ধ করতে অনীহা দেখিয়ে রাজদন্ডধারী ব্রিটিশ শাসকরা প্রশ্রয় দিয়েছিলেন বনিকের মানদন্ডকে। বলেছিলেন ভারতীয়দের জীবনযাত্রার ধরনই অস্বাস্থ্যকর , নোংরা। এই রোগ ছড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ যে জাহাজে আসা ইঁদুর এই কথাটি ঔপনিবেশিক শাসকরা স্বীকার করেন নি আদৌ। অর্থাৎ সর্বত্র ছড়াতে প্লেগ দেরী হল না। অবস্থা দেখে তাড়াহুড়ো করে গৃহীত হল দুর্দম ‘ এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট ১৮৯৭ ‘ যাতে শাসক ও প্রশাসনিক কর্তাদের দেওয়া হল অবাধ স্বাধীনতা। কোভিড – ১৯ এর ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, তখনও তেমনি ‘ ম্যাজিক ‘, ‘ দুরত্ব ‘ ও ‘ সঙ্গরোধ ‘ জাতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হল। সেই ব্যবস্থা ছিল আইনী , ব্যবস্থার রূপায়ণে ছিল দমন নীতি।

১৮৯৬ তে মহারাষ্ট্রে যে প্লেগ হয়, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে পর্যন্ত প্রভাব ফেলেছিল পুনে শহরে প্লেগের ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশী থাকায় সেখানে W.C. Rand কে Plague Commissioner রূপে নিয়োগ করা হয়। তিনি ঘরে ঘরে তল্লাশি চালানোর নামে নারী – পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রকাশ্যে রাস্তায় উলঙ্গ করে পরীক্ষা করতে থাকেন। এই অসম্মানকর পরীক্ষার প্রতিশোধ নিতে পুনের চাপেকর ভ্রাতৃত্রয় প্রতিজ্ঞা নেন। এঁরা হলেন দামোদর হরি চাপেকর, বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর, এবং বাসুদেব হরি চাপেকর। তাঁরা Rand হত্যার পরিকল্পনা করেন।

সুযোগ মিলে গেল ১৯৯৭ সালের ২২ শে জুন রানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি উপলক্ষ্যে পুনেতে যে বিশাল অনুষ্ঠান হয়। সেখানে এই তিন ভাই প্রকাশ্যে Rand কে গুলি করে হত্যা করেন। ব্রিটিশ ভারতে এই প্রথম সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে প্রতিবাদ তিন ভাইকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একই বাড়িতে তিন সহোদরের শহীদ হওয়ার এদেশে আর নেই।

কলকাতায় এই সময়টাতে প্লেগ ব্যাপকভাবে ছড়াতে থাকলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার পুঙ্খানপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর লেখা মহাস্থবির জাতক উপন্যাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমার ভয়ে যেমন কলকাতা জনশূন্য হয়েছিল তার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্লেগ মহামারীতেও তেমনি। প্লেগ সুদূর বর্মা পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ শ্রীকান্ত ‘ উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। স্বয়ং শরৎচন্দ্র এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

এই প্লেগই ছিল সদ্য ইংল্যান্ড থেকে আসা স্বামী বিবেকানন্দের মানসকন্যা ভোগিনী নিবেদিতার কাছে অগ্নিপরীক্ষা। স্বামীজি নিবেদিতাকে বাগবাজারের অঞ্চলে প্লেগ রোগীদের শুশ্রূষার কাজে নিয়োজিত করেন। রাতের পর রাত জেগে তিনি রোগীর শয্যা পার্শ্বে বসে থেকে সেবা করেছিলেন।

তাই মহামারী মহান ইতিহাসের ও জন্ম দেয়। আমরা বিশ্বাস করি এবারের মহামারী থেকে আমাদের যেমন উজ্জ্বল উদ্ধার ঘটবে, তেমনি কোনো মহৎ ঐতিহাসিক তারও হয়তো উপহার দেয়।

এবার আসি বর্তমান পরিস্থিতিতে , এই পরিস্থিতিতে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনাটি যেহেতু অন্যান্য দেশের সাথে সংযুক্ত ভারত তাই সমস্ত পর্যটন ভিসা স্থগিত রেখেছে। ২৩টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ৫৪৮ টি জেলা সেগুলো সম্পূর্নরূপে লকডাউন বা অবরুদ্ধ করণের অধীনে ছিল।

২০২০ সালের ২২ শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে ভারত প্রথম ১৪ ঘন্টা স্বেচ্ছামূলক জনতা কার্ফু পালন করেছে। পরে ২৪ শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী ১৩০ কোটির জনসংখ্যা সমৃদ্ধ সারা ভারতে ২১ দিনের জন্য লকডাউনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মাইকেল রায়ান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বলেছিলেন যে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ভারত ‘ সভাবনীয় ক্ষমতা ‘ প্রদর্শন করেছে। বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল (দ্বিতীয়) দেশ হিসাবে এই মোকাবিলা বিশ্বে একটি নজির তৈরী করবে।

যদিও বেশীরভাগ মানুষই লকডাউন দ্বারা অর্থনৈতিক বিদ্ধস্ততা সম্পর্কে উদ্বিঘ্ন। এই অর্থনৈতিক বিধ্বস্ততার ফলে অস্থায়ী শ্রমিক ক্ষুদ্র শিল্প প্রকল্প , কৃষক এবং স্ব – কর্মস্থানকারীর ওপর বিরাট প্রভাব পড়েছে। যারা পরিবহনের এবং বাজারের যোগানের অভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না।

এখন আসি সমাজের মূল চিত্রতে। আমাদের সমাজ এখন এক নতুন হিস্টিরিয়াতে জর্জরিত। মানুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের আশেপাশে থাকতে ভয় পাচ্ছে। এবং তাদের পাড়া থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে। আগুনের চেয়েও তাড়াতাড়ি এখন গুজব ছড়াচ্ছে। ভুল তথ্য , অহেতুক আতঙ্ক ছড়াবার ফলে প্রতিবেশীরা করোনা আক্রান্ত অথবা করোনা সন্দেহভাজনদের পরিবারের সাথে অস্পৃশ্য ব্যবহার করছে। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া তো দূরের কথা তাদের হেনস্থা করছে। সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব যখন সংকটে তখন মানুষের মধ্যে এই মানবিকতার অভাব।

এই মহামারী দেখে সত্যিই বড় অসহায় বোধ হয়। সমাজ কি তবে নৈতিকতা বা মূল্যবোধ কি হারিয়ে ফেলেছে?  যারা এই জরুরি পরিষেবা প্রদান করেছেন তাদের মধ্যেই ভয় সঞ্চারিত হচ্ছে, তারাই ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছেন , তারা যদি সংক্রমিত হয়ে যান এবং তাদের দ্বারাই তাদের পরিবার বিপদগ্রস্থ হবে। আমাদের উচিৎ আজ ফিজিক্যাল ডিস্টান্সিং মেনে এবং মানসিক নৈকট্যের মাধ্যমে তাদের কাছে টেনে নেওয়া।

এই অতিমারীর থাবা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ করেছে যে রাজ্যকেতা হল – মহারাষ্ট্র। ২৩ শে সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মোট ২১,০২৯ টি নতুন কোভিড – ১৯ কেস ধরা পড়েছে।এবং ৪৭৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মোট করোনা রোগীর সংখ্যা ১৫০০০ ছাড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ভেবেছিলেন ‘my family my responsibility’ অভিযান কোভিড ১৯ লড়াই জোড়দার করবে।

কোভিড ১৯ মহামারীটির প্রেক্ষিতে ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ৫১ তম (IFFI) স্থগিত করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠনটি হওয়ার কথা ছিল ২০ থেকে ২৪ শে নভেম্বর গোয়ায়। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রকাশ জাভাদেকর এক বিবৃতিতে বলেছেন গোয়ায় মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সায়ন্তের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার পর IFFI স্থগিতের এই সিদ্ধান্ত। জাভাদেকর এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রোটোকল ও নির্দেশিকা মেনে ১ থেকে ২৪ শে জানুয়ারী ২০২১ শে গোয়ায় উৎসবটি যৌথভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ক্রমবর্মান কোভিড ১৯ এর ঘটনাতে স্টেশন গুলিতে ভিড় কমানোর জন্য ৬৮টি ট্রেন যুক্ত করা হয়েছে। ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সংখ্যা বাড়ানোর সাথে সাথে বিশেষ পরিষেবা প্রদানকারী কর্মীদের শ্রেণীবিভক্ত করে হচ্ছে। বিশেষ শহরতলিতে এই পরিষেবা গুলি শুরু হয়েছে। এর ফলে ট্রেনের সংখ্যা ৩৫৫ থেকে ৪২৩ এ চলে গেছে। রেলপথে যাত্রীদের সামাজিক দুরত্ব এবং কোভিড ১৯ এর জন্য বাধ্যতামূলক সমস্ত নিয়মাবলী অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এই ৬৮ টি ট্রেনের মধ্যে ৪৬ টি মেইন লাইনেও ২২টি পোতাশ্রয়ে লাইনে (CSMT থেকে প্যানভেল ও গরেগাও) চলবে।

২৮ শে সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট অনুযায়ী একদিনে ১১,৯২১ টি কোভিড – ১৯ কেস পাওয়া গেছে মহারাষ্ট্রে। যারফলে লাফিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩,৫১,১৫৩ জনে পৌঁছেছে বলে রাজ্য স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। ৩০ শে সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের লকডাউন শেষ হওয়ার সাথে সাথে রেস্তোঁরা পুনরায় চালু করার জন্য ‘ স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি ‘ (এস ও পি) তৈরী করা হয়েছিল এবং নির্দেশিকা গুলি চূড়ান্ত করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মুম্বাই , পুনে , আওরঙ্গবাদ এবং নাগপুরের প্রতিষ্ঠানের সমিতির প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ আলোচনা করে।

অন্যান্য রাজ্য তথা মহারাষ্ট্রে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা ছোটো প্রকল্পগুলি বিভিন্ন ভাবে ব্যহত হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছে দুধের ব্যবসায়ী , সজ্জা ও ক্যাটারিং এর ব্যবসায়ী , নির্মাণ শিল্প ব্যবসায়ী ইত্যাদি। যেহেতু পরিযায়ী শ্রমিকেরা নিজেদের জন্মস্থানে চলে গেছেন সেহেতু শ্রমিকের অভাবে কাজে ঘাটতি ঘটছে। আর যেসব শ্রমিকেরা লোকাল জায়গা থেকে আসত তারা দুই থেকে তিন গুণ অর্থদাবী করছে শ্রমের নিরিখে। যারফলে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। আর পরিযায়ী শ্রমিক যারা ফিরে আসতে চাইছেন তাদের কর্মস্থলে , সেখানেও মালিক পক্ষ তাদের ফেরাতে চাইছেন না। কারণ দীর্ঘ সাত আট মাসের বেতন তাদের ভর্তুকি দিতে হবে বলে।

কোভিড – ১৯ অতিমারীর প্রভাব এতটাই গভীর ভাবে পড়েছে সমাজে যে মানুষ গৃহবন্দী থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দৈনিক মজুর ও অন্যান্য শ্রমিকেরা। লকডাউনের মধ্যে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা এবং কর্পোরেট অফিস ‘work from home’ এর অনুমতি দিয়েছে এবং সরকারি সংস্থা গুলি ৫০% কর্মচারী নিয়ে কাজ করছে। যে সমস্ত দিনমজুর ও শ্রমিকেরা রোজ হিসাবে ৪৫০ টাকা করে হাতে পেত তাদের কাছ থেকে এইটুকু সম্বল ও কোভিড – ১৯ কেড়ে নিয়েছে। যে সমস্ত দিনমজুররা নির্মাণকারীর সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেছিলেন এই লোকডাউনে তাদের অবস্থাই ভয়াবহ , যদিও তাদের মালিক সামান্য কিছু সাহায্য করেছে তবে তা দিয়ে জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভব।

তারা ৫০০ টাকার বিনিময়ে একটি ঘরে সকলে গাদাগাদি করে দিন অতিবাহিত করেছেন। যদিও পরবর্তীতে সরকার এই সমস্ত পরিযায়ী দিনমজুরদের নিজেদের জন্মস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেছেন।

সমাজের আর একটি অন্যদিকের চিত্র তুলে ধরি সেটি হল ফুলের মতো শিশুদের ওপর এই কোভিড -১৯ বা লকডাউনের কি প্রভাব পড়ছে। করোনা শিশুদের শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করতে না পারলেও শিশুদের মনের ওপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছে। তারা বুঝতে পারছে না যে তারা কেন স্কুলে যেতে পারছে না বা কেন তাদের বন্ধুদের সাথে খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের ঘোরা , খেলা , আঁকা , নাচ , গান শিখতে যাওয়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারা নিজেদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা পর্যন্ত করতে যেতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে তো শিশুরা মা – বাবার থেকেও দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। আবার অন্যদিকে শুরু হয়ে গেছে অনলাইন ক্লাস। যা শিক্ষার্থীদের কাছে একেবারেই অজানা এবং অচেনা। সব পরিবার অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবস্থা করার মতো স্বচ্ছল ও নয়। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হীনমন্যতার উদয় হচ্ছে। আবার এই দৈনিক লোকডাউন কিছু মানুষকে অলস ও উদাসীন করে তুলেছে। কারণ তাদের দৈনন্দিন কর্যাকলাপ বিঘ্নিত হচ্ছে। এখন আর ও অনেক কিছুই আগের মতো নেই।আগের মতো হতে কয়েক মাস বা বছর ও লেগে যেতে পারে।

লকডাউন চলাকালীন প্রায় ৫৯% শ্রমিক মহারাষ্ট্রের  হাতে পায়নি সামান্য মজুরিও। শিল্প সমৃদ্ধ রাজ্যে শ্রমিকদের এ হেন অবস্থা।  এই দুরবস্থা উঠে এসেছে দ্য সেন্টার ফর লেবার রিসার্চ (CLRA), হ্যাবিট্যাট ফোরাম, মশাল এবং পুনের সাবিত্রীবাই ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজি বিভাগ এর সম্মিলিত উদ্যোগে।  ২৩ শে এপ্রিল থেকে পয়লা মে এর মধ্যে সমীক্ষা করা হয়েছে। তাতেই উঠে এসেছে দেশের একটি শিল্প উন্নত রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মরত লাখ লাখ  শ্রমিকের দুর্দশার করুন চিত্র। সমীক্ষায় উঠে এসেছে শিল্পায়নের মাপকাঠিতে এগিয়ে থাকা  রাজ্য মহারাষ্ট্রের অবস্থা সব থেকে শোচনীয়। সেখানে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে  ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরও বেশি হাতে পায়নি কোনরকম মজুরি বা বেতন।  তার মধ্যে আবার ৬২% শ্রমিক  কর্মচারী  লকডাউন শুরু হতেই মালিকপক্ষ দের মনোভাব রাতারাতি বদলে যেতে দেখেছেন।  মহারাষ্ট্রে শতকরা ৫৯  জন শ্রমিকের লকডাউন শুরু হতেই  বেতন বন্ধ হয়ে যায়।  ৩৩ শতাংশ শ্রমিক কর্মচারী সমীক্ষকদের জানিয়েছেন  লকডাউন শুরু হতেই মালিকপক্ষদের মনোভাব বদলে যায়।  ১২% মানুষের অভিযোগ  লকডাউনের সময়  মালিকপক্ষের কোনো সহায়তা তারা পায়নি।

করোনা ভাইরাস এর মৃত্যুর গ্রাফ  যখন ঊর্ধ্বমুখী সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে বেকারত্ব ও কর্মহিনতা।  অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক ন্যায়  এখন নিতান্তই আকাশ কুসুম কল্পনা। সামাজিক দূরত্বের নামে এক নতুন ধারার অস্পৃশ্যতার জন্ম হয়েছে। আক্রান্ত কিংবা মৃত দের ক্ষেত্রে তো বটেই  গ্রামে শহরে সুস্থ জীবিতদের মধ্যে, পড়শী, বন্ধু, আত্মীয়, পরিজনদের  মধ্যেও করোনা অস্পৃশ্যতা  ও পারস্পরিক সন্দেহ বাতিকগ্রস্থতা  এমন স্তরে পৌঁছেছে যেন সকলে কালো আত্মা খুঁজে বেড়াচ্ছেন।  দেশের কোটি কোটি প্রান্তিক শ্রমজবী মানুষ আজ পথে,  সরকারি খোঁয়াড়ে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত  দিন কাটাচ্ছেন।  মনে পড়ে যায় কবিতার কটি লাইন –

”  যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য দাবি

তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষ যজ্ঞ কাণ্ড বেধে যাবে

ক্ষুধার্তের কাছে এই ইষ্ট নিষ্ট, আইন কানুন

সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে। ”

– রফিক আজাদ

মে মাসের শেষ থেকে মহারাষ্ট্রে ঢুকছে একের পর এক শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন ছিল শ্রমিকদের জন্যে চূড়ান্ত তৎপরতা।  ৪২ টি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন পাঠানোর কথা বলে মহারাষ্ট্র সরকার।  পশ্চিবঙ্গের আপত্তিতে বাতিল হয় ২৫ টি ট্রেন। তারপর ১৭ টি ট্রেনে ঘরে ফিরেছেন  আটকে পড়া রাজ্যের শ্রমিকেরা।

বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে হাহাকার ও মৃত্য মিছিল  এবং সাস্থ্য পরিষেবা বহু দেশে বেহাল। ৩ রা জুনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব জুড়ে  করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬৪ লক্ষ্য  ২১৩ টি দেশে।  তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অঞ্চল ভিত্তিক পরিসংখ্যান  অনুযায়ী  আমেরিকায়  ২৮.১৭,  ইউরোপে ২১.৬০, পূর্ব মেডিটেরিয়ান ৫.২০, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ২.৭২, পশ্চিম প্যাসিফিক ২.৮৩ ও আফ্রিকায় ২.০৪ লক্ষ্য মানুষ সংক্রমিত।

প্রতিদিন হু হূ করে বেড়ে চলেছে  বিভিন্ন দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যার জেরে  পৃথিবী আজ নিস্তব্ধ। তার মধ্যে কয়েকটি দেশে ৮০ শতাংশ মানুষ করোনা আক্রান্ত  রয়েছে, আমেরিকায় ১৭.৮৪ লক্ষ্য, ব্রাজিলে প্রায় ৫, রাশিয়ায় ৪.১৪  ইংল্যান্ডে ২.৭১, স্পেনে ২.৩৯, ইটালি ২.৩৩,  ভারতে ২.০, জার্মানিতে ২.৮১, তুর্কি ২.৬৪, ইরান ১.৫২ এবং ফ্রান্স ২.৬৩ লক্ষ্য। তবে জুনের পরিসংখ্যানে তখন ও পৃথিবী জুড়ে সুস্থ হয়েছে ২৯.০৫ মিলিয়ন এবং মৃত্য হয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ্য মানুষের।  সাধ্যমত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দেশ গুলো এবং নানা প্রান্তে সেই নিয়ে চলেছে গবেষণা। তার মধ্যে পিছিয়ে পরা দেশ গুলো বেশি চিন্তিত কারণ তাদের দীর্ঘ লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। ভারত উন্নয়নশীল দেশ যেখানে নেই উন্নত সাস্থ্য ব্যবস্থা অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, সচেতনতা, রয়েছে অশিক্ষা, দুর্নীতি এবং দেশের অধিকাংশ আমজনতার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।  এছাড়া বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পরিকঠামো হাইজ্যাক হয়েছে  পুঁজিবাদীদের দ্বারা পরিসংখ্যান ফলেছে ১ শতাংশ মানুষের কাছে রয়েছে ৪৫ শতাংশ বিশ্ব সম্পদ। বর্তমানে বিশ্বের ২৫ শতাংশ ক্ষুধার্ত মানুষের বসবাস ভারতে এবং দেশের ১৪ শতাংশ জনসংখ্যা অপুষ্ঠিজনিত সমস্যায় ভুগছে এবং ২১.২৫ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন।  যারা প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খায় তাদের পক্ষে রোজগার হিন ভাবে  দীর্ঘ লকডাউন টিকে থাকা কতটা কঠিন তা অনুধাবন করা অসম্ভব।  করোনা অতিমারি দেশে অভিশাপ রূপে আগমন করেছে। দেশ জুড়ে এখন অসহায় শ্রমিক, গরীব  মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে অনাহারের।

একটা সময় ছিল যখন হুড়মুড়িয়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিলো, কড়া হতে লকডাউন পালন করা হয়েছে। ছিল কড়া নজরদারিও।  সেই মুম্বাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসছে।  কারণ সেই মুম্বাই এর ধারাবি বস্তিতে  ১১ জুলাইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী  সপ্তাহে  টানা তিনদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা  ১০ এর নিচে নেমেছে। এই অবস্থায় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বস্তির মডেলের ভুয়সী  প্রশংসা করলো বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা।

ভার্চুয়াল সাংবাদিক বৈঠকে WHO – এর ডিরেক্টর জেনারেল  টেড্রোস অ্যাডহ্যানোম  গ্যাব্রিয়েসাস জানান মাত্রাছাড়া সংক্রমণ পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব তা প্রমাণ করেছে বিশ্বের কয়েকটি এলাকা। দৃষ্টান্ত হিসেবে ধারাভির নাম ও উল্লেখ করেন তিনি। WHO- এর ডিরেক্টর জেনারেল বলেন

“এরকম কয়েকটি উদাহরণ হলো  ইতালি, স্পেন এবং দক্ষিণ কোরিয়া,  এমনকি ধরবি – মুম্বাই মহানগরীর একটি ঘন বসতি পূর্ণ এলাকা।”

কিভাবে ঘুরে দাড়ালো বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বস্তি :

আড়াই বর্গকিলোমটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ধারাভি তে প্রায়  ৮০০০০০ মানুষের বাস।

ভাঙাচোরা বাড়ি এবং ঘুপচিতে থাকে মানুষ। রয়েছে গলি, তস্য গলি, খোলা নর্দমা।

গত ১১ মার্চ মুম্বাইয়ে প্রথম করোনা আক্রান্তের হদিশ মিলেছিল। আর ধারাভিতে করোনা প্রথম থাবা বসিয়েছিল ১ এপ্রিল।

ধারাভিতে  করোনা ঢুকে যাওয়ায় রীতিমত আশঙ্কিত হয় প্রশাসনের কর্তারা। সেখানে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে   এমনিতেই করোনার ভয়াল থাবার ফলে  মুম্বাইয়ের অবস্থা কি হবে তা ভেবেই রাতের ঘুম  উড়ে গেছিলো সবার। সেই অবস্থায় প্রশাসনের তরফে যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শুরু হয় নিরন্তর নজরদারি ও স্ক্রিনিং।  একনাগাড়ে চলে স্যানিটাইজেশন। ধারাভি এশিয়ার সব থেকে বড় ও ঘিঞ্জি বস্তি।  ফলে সেখানে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সেখানে করোনা নিয়ন্ত্রনে চলে আসায় উদ্বুদ্ধ ফিলিপিন্স। নিজেদের দেশে করোনা সংক্রমণ রুখতে ধারাভি মডেল অনুসরণ করতে চলেছে ম্যানিলা। সুতরাং অসুস্থদের আইসোলেট করেই ধারাভিতে সাফল্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে WHO। আর তাই এই বেসিক নিয়ম গুলি পালন করতে বলেছে তারা।  WHO জানিয়েছে এই মুহূর্তে টেস্টিং, ট্রেসিং, আইসোলেটিং এবং ট্রেনিং  ছাড়া কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। কারণ টিকার আবিষ্কার হয়নি এখনও।

করোনার মত অতিমারী পৃথিবীতে ১০০ বছর অন্তর আসে। ১৭২৯ , ১৮২০ এবং ১৯২০ তেও এমন দেখা গেছে।  ১৭২০ তে ইউরোপে Black Death বা প্লেগে ৫০ শতাংশ মানুষ মারা যায়।  ইউরোপের জনবিন্যাস ও অর্থনীতি সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ে। প্লেগে মৃত্যু হয় ২০ কোটি মানুষের। বিখ্যাত ইতালীয় লেখক Giovani Boccaccio রচিত Decamaron গ্রন্থে  এই রোগের ভয়াবহতার কথা জানা যায়। ইতালি ও স্পেন প্লেগে শতকরা ৭৫  ভাগ মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী।  জার্মানি ও ইংল্যান্ডে মারা যায় ২০ শতাংশ মানুষ।  এমনকি মা বাবাও সন্তানকে রেখে পালিয়ে যেত।

শেকসপিয়রের আমলেও বিলেতে প্লেগ হয়েছিল। নাট্যকার এর একাধিক ভাই মারা যায় প্লেগে।  ভাগ্যিস কবি ও নাট্যকার বেচেঁ গিয়েছিলেন। ১৭২০ র প্লেগের একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো ইংল্যান্ডের  বিখ্যাত কবি শেলীর  মরনত্তর  দাহ।শেলী মারা যান নৌকাডুবিতে ইতালির উপকূলে। সেসময় ও ইউরোপে জুড়ে প্লেগের প্রাবল্য। মৃত্যুর কয়েকদিন পর তাঁর সামুদ্রিক প্রাণীতে খাওয়া ছিন্নভিন্ন দেহ  সমুদ্র পাড়ে ভেসে আসে।  ইতালি সরকারের কঠোর নির্দেশ ছিল, সমুদ্র থেকে ভেসে আসা সবকিছুই পুড়িয়ে ফেলতে হবে, পাছে তা থেকে প্লেগ ছড়ায়। এই জন্যেই শেলীকে দাহ করা হয় এবং তাঁর চিতাভস্ম নিকট বন্ধু কিটস এর সমাধির পাশে  সমাহিত করা হয়। কিটস কয়েক বছর আগে যক্ষ্যা রোগে আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে বায়ু পরিবর্তন করতে এসে মারা যায়। শেলীর মৃতদেহ দেখে তাকে সনাক্তই করা যেত না যদি না তার পকেটে তার প্রিয় সখা কিটস এর কবিতার বই না থাকতো।

১৮২০ এর অতিমারী এসছিল কলেরার রূপ ধরে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় কলেরায়। তখন গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে কলেরায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ফুরসৎ ছিল না।

১৯২০তে এলো স্প্যানিশ ফ্লু। আসলে এর শুরু ১৯১৮ তে আমেরিকার কানসাসের সৈন্যদের মধ্যে। তখন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় , আমেরিকান সৈন্যদের থেকে তা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৯ এ এর প্রকৃত ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়। আর তা চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে ১৯২০ তে। চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় স্প্যানিশ ফ্লু তে। কোনো কোনো গবেষক এর মতে মৃতের সংখ্যা ১০ কোটি। তেমন আজকের এই  করোনা। পৃথিবীর সব ভাষায় গৃহীত হয়েছে শব্দটির দুঃখজনক ব্যাপ্তি এতটাই।

প্রসঙ্গঃ বিশ্বায়িত করোনা ভাইরাস: || জয়িতা চট্টোপাধ্যায় , কবি ও প্রাবন্ধি- ওয়েস্ট বেঙ্গল


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন