ফিচার্ড মত-মতান্তর

সমালোচনা ।।।  শিতাংশু গুহ

বাংলাদেশের-ভবিষ্যৎ-কি
সমালোচনা ।।।  শিতাংশু গুহ

ফেইসবুক খুললেই দেখবেন সবাই সমালোচনা করছেন। কেউ ‘এর’ সমালোচনা, কেউ ‘ওর’ সমালোচনা করছেন। সমালোচনা আপনি করতেই পারেন, আপনার সেই অধিকার আছে। কিন্তু আপনার সমালোচনা করার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি? জানি, আপনার উদ্দেশ্য মহৎ, আপনি চান যাদের সমালোচনা করছেন, তাঁরা ভালো হয়ে যাক, আপনার পরামর্শ শুনুক। কিন্তু তাঁরা শুনছে না, তাঁরা তাদের কাজ (যা আপনার অ-পছন্দ) করে যাচ্ছেন। এখন আপনি কি করবেন? সমালোচনা করতেই থাকবেন? নাকি আপনি ভিন্ন পথ ধরবেন। ভিন্ন পথও ভিন্ন ভিন্ন, একটি কট্টর পথ, অন্যটি আপোষ, অথবা এড়িয়ে যাওয়া বা মনের দু:খে বনে যাওয়া। আপনি কট্টর হতে পারবেন না, সেই সাহস বা যোগ্যতা আপনার নেই! সুতরাং, আপোষের পথ খোলা, অথবা আপনি ঘরে বসে যেতে পারেন। সমালোচনা খারাপ, আপোষও খারাপ। ঘরে বসে যাওয়া অযোগ্যতা। তাহলে  আপনি কি করবেন? আপনি স্পষ্টত: দেখছেন, সমালোচনা করে কাজ হচ্ছেনা, যাতে কাজ হয়না, আপনি তা কতকাল করবেন। আপনার মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নিশ্চয় আপনাকে ভিন্ন পথ ধরতে হবে।

কাশ্মীরে যখন মোদী সরকার ‘৩৭০’ ধারা বাতিল করেন, আমি তখন সেটি সমর্থন করে একটি কলাম লিখি। সবাই আমায় বিজেপি বানিয়ে দেয়, অথচ আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমার বিজেপি করার দরকার হয়না। তদুপরি, আমি ৩৭০ ধারা সমর্থন করলেই কি, আর না করলেই কি, কারো কিচ্ছু আসে যায় না! এনিয়ে আমার ব্যাখ্যা ছিলো যে, আমরা জন্মের পর থেকে কাশ্মীরে সমস্যা দেখে আসছি। কাশ্মীর মানে জঙ্গী, মৃত্যু, মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। অর্থাৎ ৭০ বছর ধরে ৩৭০ ধারা সেখানে শান্তি আনতে পারেনি, বা মানুষকে স্বাভাবিক জীবন দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ৩৭০ ধারা অকেজো, এটি দিয়ে কাজ হচ্ছেনা। কাজ না হলে সেটি বদলাতে হবে বৈকি, তাইনা? ৭০ বছরে যখন সুফল আসেনি, আগামী ৭০ বছরেও আসবে না। সুতরাং এটি বাতিল হওয়া উচিত। নুতন কিছু চেষ্টা করা দরকার। মোদী সরকার তাই নুতন একটি পথ ধরেছেন, ভাল কি মন্দ তা সময় বলবে? ঠিক তেমনি আপনাকে নুতন পথ ধরতে হবে, অনবরত সমালোচনা যখন কাজে আসছে না, তখন রাস্তা পাল্টাতে হবে, অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে?

একটি সহজ পন্থা হচ্ছে, ‘প্রশংসা করা’, সমালোচনা বাদ দিয়ে আপনি প্রশংসা করতে শুরু করুন। ফাঁকে ফাঁকে কিছু পরামর্শ দিন্, এতে কাজ হতে পারে, আবার নাও পারে, চেষ্টা করতে দোষ কি? মানুষের স্বভাব হচ্ছে, মানুষ নিজের সমালোচনা পছন্দ করে না? আপনি কি আপনার সমালোচনা পছন্দ করেন? আপনি যার সমালোচনা করছেন, তাঁর জায়গায় আপনাকে বসান, এবং দেখুন ওই পরিস্থিতি হলে আপনি কি করতেন? আবার দেখুন, আপনি যার সমালোচনা করছেন, সামাজিকভাবে তার অবস্থান আপনার ওপরে, হয়তো আপনি হিংসা পরায়ণ হয়ে পরনিন্দা করছেন। রাজনৈতিকভাবে আপনি যাদের সমালোচনা করছেন, তাঁরা ব্যর্থ, দালাল, চোর বলে গালমন্দ করছেন, আপনি কেন তাঁদের জায়গাটা দখল করার চেষ্টা করছেন না? আপনি এগিয়ে আসুন, মানুষের জন্যে কাজ করুন, সবাই আপনার পাশে দাঁড়াবে। আসলে কি দাঁড়াবে? না, দাঁড়াবে না, আপনার সমালোচনা করবে। সমাজে কিছু লোক আছে, সমালোচনা করাই তাঁদের কাজ। সতর্কভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, এদের কোন অর্জন নেই, এদের পাশে কেউ নেই, এদের একটি ‘হামবড়া’ ভাব আছে!

সমালোচনা একটি ঋণাত্মক বিষয়। যতই আপনি অন্যের সমালোচনা করছেন, ততই আপনি নিজের ক্ষতি করছেন, হয়তো সমাজের ক্ষতি করছেন। বলা হয়, মানুষ তাঁর কর্মের দ্বারা ক্রমশ আত্মার উন্নতি করতে সচেষ্ট থাকবে। সমালোচনা বা নেগেটিভ চিন্তাধারা আত্মার অবনতি ঘটায়। যা আপনার জন্যে ক্ষতিকারক তা আপনি করবেন কেন? আমি বলছি না যে আপনি গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন না, অবশ্যই পারবেন, কিন্তু সমালোচনা যেন আপনার দৈনন্দিন কর্ম না হয়? আমি যৌবনে একবার ‘মাতাল’ হয়েছিলাম। একবারই, বন্ধুরা মিলে ‘চুল্লু’ খাইয়ে মাতাল করে দিয়েছিলো। সেই রাতে আমি কি করেছি জানিনা, পরদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে লেপের নিচে জন্মদিনের পোশাক পরা অবস্থায় আবিষ্কার করেছি। যাহোক, স্নান সেরে খাওয়া-দাওয়া করে আমি বেরিয়ে যাই। বন্ধুরা জানালো, আগের রাতে আমি সেক্সপিয়ার হয়ে গিয়েছিলাম, গালমন্দ তো ছিলই, সাথে কিছুটা ধস্তাধস্তি। তারাই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলো। পরে মা বলেছিলো, বড়দা আমার জামাকাপড় খুলে শুইয়ে দিয়েছিলো। অথচ কেউ আমায় কিচ্ছু বলেনি। সম্ভবত: দু’একদিন পর বাবা শুধু বলেছিলো, ‘তুমি মদ খাও ঠিক আছে, মদ যেন তোমাকে না খায়’।

না, আমি মদ খাওয়া ছাড়িনি, অবশ্য তেমন মদ কোন কালেই খাইনি, এখনো মাঝেমধ্যে পার্টি-টার্টিতে অল্পবিস্তর খাই? কিন্তু বাবার কথাটি ভুলিনি, এজন্যে আর কখনো মাতাল হইনি, হবও না। বলছিলাম, সমালোচনা আপনি করুন, সমালোচনা যেন আপনাকে খেয়ে না ফেলে। আমি উপদেশ দিচ্ছিনা, আপনাকে সাঁধু-সন্ন্যাসী হতে পরামর্শ দিচ্ছিনা, কারণ ওঁরা সমাজের কোন কাজে লাগেনা। আপনি সমাজবদ্ধ জীব, সমাজের কল্যানে আপনাকে কাজ করতে হবে, কারণ এই সমাজে আপনার ভালবাসার মানুষগুলো বসবাস করে, পরবর্তী প্রজন্ম বসবাস করবে, তাই আপনার একটি দায়িত্ব আছে। উন্নত দেশগুলোতে এঁরা একটি গাছ কাটলে এক বা একাধিক গাছ লাগায়। এটি পরিবেশের জন্যে। আপনার জন্যে শুধু একটি আকাশ, যেই বাতাসে আপনি নিশ্বাস নিচ্ছেন, বিশ্বের ৮বিলিয়ন মানুষ একই বাতাসে নিশ্বাস নেন, আপনার দায়িত্ব এই বাতাস একটু বিশুদ্ধ রাখার চেষ্টা করা। এজন্যেই আপনাকে গাছ লাগাতে বলা হয়!

যে সময়টা আপনি অন্যের সমালোচনায় নষ্ট করছেন, সেই সময়টায় আপনি ব্ল্যাকনিতে একটি ফুলের বাগান করতে পারেন। ফুল পূজায় লাগে, প্রিয়ার খোঁপায় একটি ফুল গুঁজে দিতে পারেন। এতে আপনি অজান্তে গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করলেন। গল্পটি জানেন তো যে এক স্কুলে শিক্ষক প্রায়শ: জিজ্ঞাসা করতেন ‘আজ কে কিভাবে মানুষের উপকার করেছো? ছাত্ররা বলতো। এক ছাত্র একদিন বললো, সে সেদিন কারো উপকার করেনি। শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি স্কুলে আসার সময় কি করেছো? ছাত্রটি বললো, দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে আমি দৌড়ে আসছিলাম, পথে একটি পাথর পড়েছিলো, সেটি পা-দিয়ে ঠেলে একপাশে সরিয়ে রেখেছি। আর? রাস্তায় একটি গাছের ছোট্ট ডাল পড়েছিল, সেটি দূরে ফেলে দিয়েছি। শিক্ষক বললেন, তুমি আজ দু’টি ভাল কাজ করেছো। বিষয়টি তাই, সমালোচনা বাদ দিয়ে আপনি ছোট ছোট ভাল কাজ করুন। লোকে ঠাট্টা করে বলে, ‘ভাল হতে পয়সা লাগেনা’। ঘটনা তাই! আপনি যদি প্রতিরাতে ঘুমাতে যাবার সময় ত্রিশ সেকেন্ড চিন্তা করেন যে, আমি কি আজ কোন খারাপ কাজ করেছি? দেখবেন, এক সময় আপনি আর খারাপ কাজ করছেন না?

শুধু শুধু সমালোচনা করা খারাপ কাজ, এতে আপনি, যার সমালোচনা করছেন তিনি বা সমাজ উপকৃত হয়না। আপনি একটি বই’র সমালোচনা করছেন, একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ বা অরাজকতার নিন্দা করছেন, আন্দোলন করছেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামী হচ্ছেন, এটি আপনার দায়িত্ব, সমালোচনা নয়। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম মহৎ, যাঁরা এটি করে তাঁরা মহান। ইরানের মেয়ে ‘নার্গিস মোহাম্মদী’ এবার (২০২৩) শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, তিনি জেলবন্ধী, নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি অগ্রণী। নার্গিসের প্রচুর সমালোচনা আছে, যারা তাঁর সমালোচক তারা ‘গার্বেজ’। গার্বেজ ও ট্র্যাশের মধ্যে একটি সূক্ষ্ণ পার্থক্য আছে, গার্বেজ হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত ট্র্যাশ। অনবরত অন্যের সমালোচনা করে আপনি ‘গার্বেজ’ হতে চাননা নিশ্চয়?

একজন মানুষ কিছু ভাল কাজ করেন, কিছু খারাপ কাজ করেন, কেউ একতরফা শুধু ভাল, বা শুধু খারাপ কাজ করেনা। একজন চোর যখন চুরি করে ফ্যামিলি’র মুখে অন্ন যোগায়, আপনি তার চুরির সমালোচনা করতে পারেন, তিনি পরিবারকে দেখছেন, এর মৌন প্রশংসা করবেন না কেন? যাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে পুকুর চুরি করে তাদের কথা বলছি না, আমি বলছি একজন সামান্য চোরের কথা। এজন্যে হিন্দু ধর্মে স্থায়ী কোন স্বর্গ বা নরক নেই? বলা হয়, মৃত্যু’র পর ভালো কাজের জন্যে তিনি কিছুকাল স্বর্গবাস করবেন, আর খারাপ কাজের জন্যে কিছুকাল নরক যন্ত্রনা ভোগ করবেন। এরপর আবার মর্ত্যে ফিরে আসবেন, যতদিন না ‘মোক্ষ’ বা মুক্তি লাভ করবেন। এই থিওরীর নাম ‘পুনর্জন্ম’। না ভাই, আমি ধর্ম কথা শুনাচ্ছিনা। ওটা হুজুরদের কাজ, দেখছেন তো ওঁরা কিভাবে অন্য ধর্মের সমালোচনা করে?

সত্তর দশকের শেষের দিকে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের সাথে একটি কলেজে কিছুকাল কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। তিনি সংশয়বাদী ছিলেন, প্রায়শ: বলতেন, ‘কখনো মন্দির-মসজিদে পয়সা দিবিনা’। তাঁর কথা রাখতে পারিনি, পয়সা দিতে হয়, কিন্তু নিউইয়র্কের মন্দিরগুলোর দিকে যদি আপনি তাকান, দেখবেন সকল মন্দিরে সমস্যা। এদের অধিকাংশ আপনাকে ধর্মকথা, নীতিকথা শোনায়, নিজে তা পালন করেনা। যেমন দেখুন, জ্যোতিষী আপনার ভাগ্য বদলানোর জন্যে দামি ‘পাথর’ দেয়, আর নিজের ভাগ্য বদলানোর জন্যে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেয়! ‘এস্ট্রোনমি’ আর ‘এস্ট্রোলজি’ দু’টি ভিন্ন জিনিষ। আমার একটি পেপার ছিলো এস্ট্রোনমি, কিচ্ছু বুঝিনি, পরীক্ষায় পাশের জন্যে পড়েছি। মহাকাশ গবেষণার ভিত্তি এস্ট্রোনমি। ভারত চাঁদে গেছে, এটি এস্ট্রোনমি। অথচ সামাজিক মাধ্যমে আপনি এর কত বিরূপ সমালোচনা দেখেছেন। এগুলো অর্থহীন। সমালোচনার জন্যে সমালোচনা। রাবন সীতাকে অপহরণ করলো, আজো এর প্রতিবাদ ও সমালোচনা হচ্ছে। রাবন আকাশ পথে সীতাকে লঙ্কা নগরীতে নিয়ে গেলো। একদল ভাবলো এটি ভুয়া, তাঁরা এর কঠোর সমালোচক। ঠিক আছে। আপনি তো এটিও ভাবতে পারেন যে, আচ্ছা, তাহলে তখনো আকাশ পথে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিলো? ঘটনা হচ্ছে,    আপনি একটি বিষয়কে কিভাবে দেখছেন? গাছ থেকে আপেল নীচে পরে এটি সবাই দেখেছে, শুধু নিউটন চিন্তা করলেন, নীচে পড়লো কেন, উপরে গেলো না কেন? তাঁর চিন্তায় মানবজাতি ‘মধ্যাকর্ষণ’ জানতে পারলো।

বিষয়টি হচ্ছে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি। একটি রমণীকে আপনি কন্যার মত দেখতে পারেন, অথবা প্রেমিকার মত ভাবতে পারেন, প্রশ্নটা হচ্ছে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি, যাকে নিয়ে আপনার এ দৃষ্টিভঙ্গি, তার কিন্তু তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না! আপনি ইতিবাচকভাবে দেখলে এক রকম, নেতিবাচকভাবে দেখলে আর এক রকম। কৃষ্ণ, রাম, মোহাম্মদ, যীশু সবার সমালোচনা আছে, আপনার সমালোচনা আছে, আমার সমালোচনা আছে, থাকবে, থাকুক। শেখ হাসিনার সমালোচনা আছে, মোদী, বাইডেন, বা ট্রাম্পের সমালোচনা আছে, থাকবে। এঁরা কিছু ভাল কাজ করেছেন, হয়তো কারো কারো দৃষ্টিতে কিছু মন্দ করেছেন, তাই সমালোচনা ছিলো, আছে, থাকবে। সমালোচনা মানুষের মনের খোরাক। সমালোচনা হোক উপজীব্য। এ সময়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘মার্কিন ভিসানীতি’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা হোক ইতিবাচক, সমস্যা নেতিবাচক সমালোচনা নিয়ে! সেই পুরানো ডায়লগ, মদ খান, মদ যেন আপনাকে না খায়! তদ্রুপ, সমালোচনা করুন, সমালোচনা যেন আপনাকে না খায়! সমালোচনা যেন পরনিন্দা, পরচর্চায় পরিণত না হয়! শিতাংশু গুহ, ফেব্রুয়ারি ২০২৪। [email protected];

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন