মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১| সুশীল কুমার পোদ্দার

স্বাধীনতাত্তোর-আমার-শৈশবের-দিনগুলি

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১| সুশীল কুমার পোদ্দার

সে অনেক কাল আগের কথা। সদ্য স্বাধীন দেশ। চারিদিকে ভগ্ন স্তূপ। বাড়ীর পেছনটা জংগলাকীর্ণ। সে জংগলে দিনের বেলা ঢুকতেই ভয় হয়। মানুষের মৃতদেহ খেতে খেতে অতি অভ্যস্ত শিয়ালের দল প্রচুর শিশু শাবক নিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়। দিন দুপুরে ওরা লোকালয় থেকে ধরে নিয়ে যায় মুরগী ছানাগুলোকে।

আমি তখন অনেক ছোট। ঐ লতা গুল্ম ভরা জংগল আমায় হাত ছানি দিয়ে ডাকে। আতা গাছে ঝুলে থাকা পাকা আতা, রঙ্গিন ডালিম, বিশাল বিস্তৃত মান-কচুর পাতারা বাতাসে দুলে দুলে আমায় ডেকে নিয়ে যায় জংগলের নিভৃত কোনে। আমি মায়ের নিষেধ অবজ্ঞা করে আতার বনে ভালো আরও ভালো আতার খোঁজে এ ডাল থেকে ও ডালে ঘুরে বেড়াই। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা ছিন্ন বস্ত্র, তার পাশে এক মাথার খুলি। আমার দিকে চক্ষুহীন চোখে চেয়ে আছে। এক হিম শীতল অনুভূতি আমার শিরদাঁড়া বেয়ে সাপের মতো উঠে আসে। আমি বার বার আছার খেতে খেতে দৌড়ে চলি। ছোট বেলার সেই স্মৃতি আজও মনের কোনে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। সেই করোটির শূন্য কোটর আজও একি ভাবে চেয়ে থাকে আমার দিকে।

রাস্তা পার হলেই বিরাট পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ী। লোকে তাকে আদালত বলে চেনে। এই আদালত প্রাঙ্গণে বিরাট এক কাঠ মালতী গাছ। অজস্র ফুল ফুটে থাকে সে গাছে। গাছের পাশে সান বাধানো এক বিরাট ইঁদারা। কালো মিশমিশে জল। আমি সেই কালো জলের আয়নায় মুখ দেখে আমার বাল্য বন্ধুর নাম ধরে ডাক দেই। নামের ডাক দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কামাল কামাল কাম..ল বলে। এই খেলা খেলতে খেলতে কতো দিন কতো দুপুর পার করে দিয়েছি। তখন তো জানিনি ওটা একটা বদ্ধ-ভূমি। কতো মানুষের শেষ আর্তচিৎকার , শেষ নিঃশ্বাস জমাট বেধে রয়েছে এ কূপের অন্ধকারে।

একদিন দেখতে পাই বিরাট জটলা ঐ ইঁদারা ঘিরে। ডুবুরী নামে সেই কালো জলে। একে একে তুলে আনে অজস্র কংকাল। হাতের অস্থি, পায়ের অস্থি, মাথার খুলি। কেউ কেউ সেই জড় বস্তুর মাঝে আকুলি বিকুলি করে আপন জন খুঁজে বেড়ায়। আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কাঠ মালতী গাছটাকে অপার্থিব বলে মনে হয়। পাক বাহিনীর নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা গাছটা আমায় দূরে ঠেলে দেয়। ওর ফুলের ঘ্রাণে আমি খুঁজে পাই গলিত লাশের গন্ধ।

জটলা ইঁদারা ছেড়ে এগিয়ে চলে আদালতের পেছন দিকে। এর আগে যাওয়ার সাহস হয়নি কখনো। ছোট বড় অসংখ্য কাঁঠাল গাছ। প্রাচীন দেওয়ালের গা বেয়ে বেড়ে ওঠা বটের ঝুরি। ভগ্ন দেওয়ালের এক কোনে বিরাট এক ডুমুরের গাছ। বৃষ্টি বাদলে বিস্তৃীর্ন অঞ্চল ধসে যেয়ে নালার মতো রূপ নিয়েছে। জটলা এসে থামে নালার গা ঘেঁষা এক কাঁঠাল গাছের নিচে। কাঁঠাল গাছে ঝুলে আছে মরচে ধরা কিছু ছিন্ন বস্ত্র। একদা ঐ বস্ত্রের মাঝে দেহ ছিল, ছিলো কোন প্রাণভয়ে আকুতি ভরা কোন মানব জীবন। ধসে যাওয়া মাটির পলেস্তারায় ছড়িয়ে আছে তারি অসংখ্য প্রমাণ।

এমনি কতো বীভৎস ও আতংক ভরা স্মৃতি আমার শৈশব জুড়ে। তখন বিকেল হলেই ঝুপ করে রাত্রি নামতো। প্রগাঢ় অন্ধকারে কুপা-বাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসতাম। আমরা যে বাসায় থাকতাম লোকে তাকে বড় বাড়ী হিসেবে চেনে। বাড়ীর সামনের বৃহদাকার অট্টালিকার বেশ কিছু অংশ দগ্ধ। ছোট্ট এক কামরায় পাক সেনাদের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান জমিদার মাতা। তার অশান্ত অশরীরী আত্মা অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ী জুড়ে। প্রতি রাতে কেউ না কেউ দেখতে পায় সেই অশরীরী ছায়াকে। একবার মা জানালা দিয়ে সুপুরি গাছের প্রলম্বিত ছায়াকে সেই অশরীরীর ভেবে চিৎকার করে মূর্ছা যান। জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয় পেরেক দিয়ে। কিন্তু পড়তে বসে আমার অবাধ্য মন টিনের বেড়ার অসংখ্য ছিদ্রপথে অশরীরী ছায়াকে খুঁজে বেড়ায়। রাতের অন্ধকারে নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসে আতস বাজীর শব্দ। বাবা মাকে বলেন আবার বুঝি খালি হলো কোন মায়ের বুক।

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি…

চ ল বে ….

লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে 

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন