মত-মতান্তর

দেয়াল তুললেই ঘর, ভেঙে ফেললেই পৃথিবী…|||| বাণী ইয়াসমিন হাসি

বাণী ইয়াসমিন হাসি

দেয়াল তুললেই ঘর, ভেঙে ফেললেই পৃথিবী…|||| বাণী ইয়াসমিন হাসি

তোমার শহরেও কি মেঘ জমেছে? আমার এখানে মেঘেদের মেলা। পাঠিয়ে দিলাম; বৃষ্টি নামিয়ে নিও। হাতের মুঠো একবার আলগা করলে হাত থেকে হাত সরে যায়। তখন আর হাতের মাঝে হাত থাকে না!

একটা শেষ হয়ে যাওয়া গল্পের নাম ‘ভালো থেকো’। জীবন, সময় এবং বাস্তবতা মানুষকে কখনো কখনো এমন এক অচেনা মোড়ে দাঁড় করায়, যেখান থেকে ফেরার কোন রাস্তা জানা থাকে না। জীবনের ফেলে আসা দিনের সত্যি যাচাই করতে গেলে জীবনকে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। কিন্তু সময় এবং জীবন কোনোটাই সেই সুযোগ দেয় না যে।

অনতিক্রম্য দূরত্ব। জীবন নি:স্ব করে দেওয়া মায়া। না পারা যায় তার সাথে জীবন কাটাতে, না পারা যায় তাকে মন থেকে মুছে ফেলতে। দিনশেষে পুরো মন মাথা আর চোখজুড়ে একটা মুখই থাকে। এ থেকে মুক্তি মেলে না। গোটা জীবনটাই মিথ্যে হয়ে যায়। তার কাছে যাওয়া যায় না আবার তাকে ছেড়ে থাকাটাও মৃত্যুসম।

প্রেম মানেই তো পুজো কিংবা সমর্পন। প্রেমিক মাত্রই তাই প্রেমাস্পদকে দেবতা জ্ঞান করে। সে আমার পুজোর আদৌ যোগ্য কিনা বা আমার পুজোয় তার মন ভরে কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। চিরজন্ম সঙ্গোপনে পুজিবো একাকী। পুজারীর তৃপ্তি বা প্রাপ্তিই এখানে বড় কথা। দেবতা যদি আকাশ ছেড়ে মাটির পৃথিবীতে নিজেকে নামিয়ে আনে সেই দায় তো পুজারীর না!

মন চাইলেই কথা বলা যায় তার সাথে, ডাকলেই দেখা হওয়া সম্ভব। এমনকি ইচ্ছে হলে দূরে কোথাও চলে যাওয়া যায়। সময়, সুযোগ এবং ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এগুলোর কোনটাই যখন আপনি করবেন না, তখন বুঝবেন আপনি বড় হয়ে গেছেন। সে ভালো থাকলে, সব ঠিকঠাক চললে মনেও পড়ে না। কিন্তু একটু খারাপ থাকলেই অস্থির লাগে। এখনো কেন এমন খারাপ লাগে। এক পৃথিবী সমান দূরত্ব যার সাথে তার জন্যই কেন মন পোড়ে ?

হৃদয়ে উষ্ণতা ছড়ানো মানুষের বড্ড আকাল এই দুনিয়ায়। তবে খোঁচাখুচি করার মানুষের অভাব নেই চারপাশে। দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু দেখা হওয়ার নয় এমন মানুষ যার পৃথিবীতে জায়গা করে নেয় তার ভালো থাকা খুব কঠিন। মনেরও যত্ন লাগে। মনের ক্ষতে মলম লাগানো মানুষটাই দিনশেষে আশ্রয় হয়ে ওঠে। সেখানে সব হিসেব অকার্যকর।

ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেলেও আবার শুরু থেকেই শুরু করে মানুষ। ঝড় জলের রাতে হেঁটে হেঁটেই সামনে আগাতে হয়। পা পিছলাবে, হাতে ধরা বাতিটা হয়তো ঝড়ো বাতাসে নিভে যাবে। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়েই আবার গন্তব্যের দিকে আগাতে হয়। টানেলের ওপাশে আলো হাতে কেউ না কেউ ঠিক দাঁড়িয়ে থাকে।

সারা দুনিয়া আঙ্গুল তুললেও লাগে না। কিন্তু যাকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ ধরে নেওয়া হয়; তার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন রক্তাক্ত করে। আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া বসে আঁধারে মরিগো কাঁদিয়া …যে মানুষটা গোটা পৃথিবীর সমান দামী আপনার কাছে; তার জীবনের কোথাও হয়তো আপনি নেই! কি নির্মম তাই না? আর এই গল্পের সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো, এ ব্যথার কোন নালিশ নেই।

হারিয়ে খোঁজার চেয়ে, থাকতেই আঁকড়ে থাকা ভালো। জীবনে টানাপোড়ন থাকবে, না পাওয়া থাকবে, পাঁজর ভাঙ্গা হাহাকার থাকবে। সবকিছু ছাপিয়ে ছোট ছোট প্রাপ্তিগুলোর মাঝে যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে সেটাকে আস্বাদন করতে পারার নামই সুখ।

নিজের অনুভূতি, ভালোলাগা, খারাপলাগা কখনো অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে নেই। মানুষের মন তো, সেখানে কোন জোর খাটে না। দাবি তৈরি হওয়ার আগেই দাবি করাটা রীতিমত অন্যায়। না বলতে না পারা আর হ্যাঁ বলার মধ্যে এক পৃথিবী দূরত্ব। কেউ কারো ব্যথা ছুঁতে পারে না। প্রত্যাশার পারদ তাই বাড়তে না দেওয়ায় ভালো। কিন্তু নিয়ম মেনে, হিসেব করে কিছুই যে ঘটে না। কোন প্রকারের মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই যে অনুভূতি জন্ম নেয় তার দায় এবং যন্ত্রণা দুইটাই অসহনীয়।

যা পাওয়া হয়নি তা হারানোর ভয় তো নেই, হয়তো না পাওয়ার যন্ত্রণা থাকতে পারে। অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রেও কিছুটা হিসেবী হওয়া উচিত। অনুভূতি অপাত্রে দানের জন্য নয়। যার তার জন্য, যেখানে সেখানে এগুলো বিলি করবেন না। বরং সেই মানুষটার জন্য জমিয়ে রাখুন যার কাছে আপানার অনুভূতিগুলো পৃথিবীর আর সবকিছুর চেয়ে দামী। কেউ কেউ আপনার জীবনে আসবে। আপনার প্রতি চরম দুর্বলতা প্রকাশ করবে। তার এই আর্দ্রতা হয়তো আপনাকেও ছুঁয়ে যাবে। এক পর্যায়ে তার প্রতি আপনার একধরণের নির্ভরতা জন্ম নেবে। তখন সে আপনার পৃথিবী থেকে আপনাকে বের করে আনবে এবং সে নিজে আপনার পৃথিবী হয়ে দাঁড়াবে। তারপর একদিন সেই পৃথিবী থেকে আপনাকে বের করে দেবে।

কোটি কোটি ছিন্ন মেঘ জমেছে এখানে এই বিষন্ন বেলায়, শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখি না আর খণ্ড খণ্ড স্বপ্নের শিখরে। এই মেঘ, এই স্বপ্ন, ভালোবাসা আমি লিখে দিয়ে যাবো, তোমার উদ্দেশে। আর সব অস্ত যাবে, শুধু এই গান অস্ত যাবে না কখনো। -মহাদেব সাহার কবিতার লাইনগুলোর মাঝেই কেউ কেউ প্রেম অথবা স্বপ্ন খুঁজে ফেরে।

দুটো মানুষের মধ্যে প্রেম ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকতে পারে। মায়া থাকে, নির্ভরতা থাকে, ভালোলাগা থাকে, মন কেমন করা থাকে। আরো কত কি থাকে।

সব সম্পর্কই প্রেম না; কিছু সম্পর্ক হলো সম্পদ। সম্পর্ককে আটপৌরে বা সরলীকরণ করাটাই মস্ত বড় ভুল। দীর্ঘ নীরবতা ভালো। সেই নীরবতা ভেঙে শব্দেরা যখন ভিড় করে তারচেয়ে শ্রুতিমধুর আর কিছু হয় না। যেন, ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলো গো।’

আহা প্রেম ! কত রূপে; কত আবেদনেই না বিরাজমান !

সীমানার কাছে যেতে যেতে মনে হলো, আর যাবো না। যদি কোথাও ভুল হয়ে থাকে, ফিরে যাই দূরে।

আবারও আসি; সব ভুলে,সীমানা অতিক্রম করার দুর্গম সাহস নিয়ে।

দেয়াল তুললেই ঘর, ভেঙ্গে ফেললেই কিন্তু পৃথিবী। প্রতিটা মানুষেরই কোন না কোন ‘না পাওয়া’ থাকে। এই না পাওয়াটা খুব আপন আর নিজের। অনেকটা তুলে রাখা শাড়ি বা জামা কাপড়ের মতন। মাঝে মাঝে বের করে ভাঁজ ভেঙে নেড়েচেড়ে দেখতে ভালো লাগে। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন, হৃদয়হীন বা বাস্তববাদী মানুষটাও কখনো কখনো নিজের সেই একান্ত শূণ্যতার হাহাকারে ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়।

 

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

 

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন