ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ১৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ হঠাৎ করিয়া নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকিয়া গেল। চরাচর মুখরিত করিয়া আকাশ ভাঙিয়া অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরিল। মাঠ-ঘাট প্রান্তর অবলাকে লইয়া ভাসিয়া গেল এক অপার্থিব আনন্দধারায়। মেঘমেদুর প্রকৃতি অবলার হ্রদয়ে জাগাইয়া তুলিল শৈশবের অব্যক্ত আকুতি। এমনি দিনে অবলা তাহার দিদিদের বৃষ্টিতে ভিজিতে দেখিত। তাহারও ইচ্ছা হইত ঝুম বৃষ্টি মাথায় লইয়া উন্মুক্ত প্রান্তরে ছুটিয়া বেড়াইতে, টইটুম্বুর দীঘির গভীর হলুদাভ জলের মাঝে ঝরে পড়া বৃষ্টির আন্দোলন দেখিতে। পাছে সে রোগ বাধাইয়া বসে, বংশের একমাত্র প্রদীপের জীবন বিপন্ন হয় তাহা ভাবিয়া সবাই তাহাকে চোখে চোখে রাখিত। গাছ হইতে টুপ করিয়া আম পড়িত, জাম ঝরিত, ঝরিত বাদুরের অর্ধভুক্ত লিচু। তাহার ইচ্ছা হইত ছুটিয়া যাইতে; ইচ্ছা হইত জামার আস্তিনে মুছিয়া ওগুলো মুখে পুরিয়া দিতে। কিন্তু তাহার ইচ্ছা মনের বাহিরে আসিবার সাহস কোনদিন অর্জন করিতে পারে নাই। আজ সে ইচ্ছাগুলো মনের অন্দর হইতে ডানা মেলিয়া আকাশে উড়াল দিল। ইচ্ছাগুলো অবলাকে ডাকিল লইয়া গেল উপচিয়ে পড়া পুকুর পারে। অবলা অবাক হইয়া দেখিল ঝরে পড়া বৃষ্টির লাস্যময়ী রূপ। পুকুরের জলে ছোট ছোট জলস্তম্ভ স্ফটিকের মতো প্রজ্বলিত হইয়া অবলাকে আরও কাছে ডাকিল। অবলা আস্তে আস্তে নামিয়া গেল পুকুরের গহীন জলে। মেঘের আড়াল হইতে তাহার পিতা অগ্নিশর্মা হইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল – অবলা, উঠে আয়, ঠাকুরমা তাহার অপত্য স্নেহ দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তাহাকে রুখিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু অবলা আজ কারোর কথা শুনিল না। মনের মাঝে চিরস্থায়ী বাস করা তাহাদের নিষেধাজ্ঞা আজ তাহার ইচ্ছার কাছে হার মানিল। অবলা ডুব সাতারে পৌঁছিয়া গেল মধ্য পুকুরে। পথে দেখা মেলিল বর্ণীল শাপলার সাথে, প্রস্ফুটিত পদ্মের সাথে, পদ্মপাতার সাথে। গরজিয়া উঠিল মেঘ, আকাশের একপ্রান্ত হইতে অন্য-প্রান্তে বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। অবলার মনে আজ কোন ভয় জাগিল না। সে মনে মনে ভাবিল – একটামাত্র জীবন, তাহা ভয়, শাসনের বেড়াজালে বাধা পড়িয়া কতো কিছু থেকে তাহাকে বঞ্চিত করিয়াছে!

অবলার মনের অন্দরে গোবিন্দচন্দ্র আসিয়া হাজির হইলো। কবি তাহার দুখী দুখী মুখে মৃদু হাসি টানিয়া আনিয়া বলিল – অবলা, আমার ‘বর্ষার বিল’ কবিতাটি কোনদিন তোমায় মনকে আবেগের জলে প্লাবিত করিতে পারে নাই। তুমি আমার আবেগকে নিছক বাড়াবাড়ি বলিয়া মনে করিয়াছ।তোমায় আমি কোনদিন দোষ দেই নাই। তুমি তো কখনো বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিকে দেখার সুযোগই পাওনি! অবলা লজ্জিত হইল। অবলার মনে হইলো কবি এতটুকু বাড়াবাড়ি করেননি। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যকে কি কোন শব্দের বাধনে, কোন ছন্দের গ্রন্থিতে বাধা যায়?

পূন্যের পবিত্র তীর্থ অবলার দেহমনে ছড়াইয়া দিল এক গভীর প্রশান্তি। পুকুরের অপর পারে ছোট্ট এক বনানী। ঘন ঘাস পার হইতেই অবলার কানে বাজিল নূপুরের ক্ষীণ রিনরিন শব্দ। অবলা পেছন ফিরিয়া তাকাইল। অবলা বুঝিতে পারিল প্রকৃতি তাহার সঙ্গীতের লয় পরিবর্তন করিয়াছে। অবলা কান পাতিয়া শুনিল বাঁশ বনে সরু পাতার ‘পর ,বট বৃক্ষের ডিম্বাকৃতি পাতার ‘পর, সজনে গাছের চিরল পাতার ‘পর , মান গাছের বিশাল আকৃতির পাতার ‘পরে ঝরিয়া পড়া বৃষ্টির বিচিত্র সুর । লতাগুল্মের নীচে আশ্রয় নেওয়া বৃষ্টি ভেজা একদল হাঁস তাহার বিস্ময় ভাঙ্গিয়া প্যাকপ্যাক করিয়া উঠিল। অবলা বনের আরও গভীরে ঢুকিয়া পড়িল। তাহার মনে হইলো কে যেন তাহাকে উচ্চস্বরে ডাকিয়া চলিয়াছে। বৃষ্টির প্রবল বেগ সেই শব্দকে ভাসাইয়া ভিন্ন পথে প্রবাহিত করিলেও, সেই অর্ধভঙ্গ শব্দ যে কালিচরনের তাহা বুঝিতে তাহার বাকী রহিল না। পুকুর পার ধরিয়া খর্বকায় কালিচরণ ছাতা হাতে ভিজিতে ভিজিতে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

‘বাবু তুমি আমায় আর কতো কষ্ট দেবে? এই বয়সে অসুখ বিসুখ বাধাইয়া বিছানায় পড়িয়া গেলে তোমায় কে বাঁচাইবে ?’ অবলা কালিচরণের কথায় উত্তর না দিয়া তাহার হাত হইতে ছাতাটি একরকম কাড়িয়া লইয়া পুকুরের জলে ভাসাইয়া দিল। কালিচরণ ভয় পাইয়া তাহার দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকিয়া রহিল। মানুষ তাহাকে লইয়া একথা সেকথা বলে। তবে কি বাবু পাগল হইয়া গেলেন? অবলা কালিচরণকে কাছে ডাকিয়া বলিল – কালিচরণ, তুমি কক্ষনো এমন ঝুম বৃষ্টির মাঝে ভিজিয়াছ? অবলা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। কালিচরণ, তুমি কি কখনো বৃষ্টির মাঝে প্রকৃতির গান শুনিয়াছ? অবলা তাহার কথায় ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। আড়ষ্ট হইয়া বলিল, বাবু তুমি ঠাণ্ডায় কাঁপিতেছ, শীঘ্র বাড়ী ফিরিয়া চল। অবলা তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল – কালিচরণ, এই যে আকাশ ভাঙ্গিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে- বলতো এ বৃষ্টি কার জন্য? কালিচরণ মাথা নাড়াইয়া বলিল, বাবু, প্রকৃতির নিয়মে বৃষ্টি আসে, কার জন্য আসে তাহাতো জানিনা। আমিও আগে জানিতাম না। আজ জানিলাম। দেখ, বৃক্ষলতা আনন্দে কেমন উদ্বাহু নাচিতেছে? দেখ কেমন করিয়া ব্যাঙেরা ঐকতান তুলিয়াছে। ওরাই বৃষ্টিকে আবাহন করে। কালিচরণ, গ্রীষ্মের তাপদাহে আমাদের বাগানের ফুলগাছগুলো যখন মুষড়ে পড়ে তুমিইতো নিয়ম করিয়া ওঁদের জল দাও। কিন্তু বাগান জুড়িয়া ঐ যে আমগাছ, জামগাছ, কাঁঠালগাছ, কলাগাছ ওঁদের কপালে তো জল জুটে না। ওঁদেরতো তৃষ্ণা জাগে! ওরাই প্রকৃতির কাছ প্রার্থনা করে জলের। ওঁদের প্রার্থনায় প্রকৃতি সারা দেয়। মাঠ ঘাট প্রান্তর ডুবাইয়া দেয় বৃষ্টির জলে। কালিচরণ দু’হাত জোড় করিয়া বলিল, বাবু বাড়ী চল। পথে চলিতে চলিতে অবলা একদলা কর্দমাক্ত মাটি হাতে তুলিয়া লইয়া গভীর নিঃশ্বাস লইল। পুলকিত হইয়া কালিচরণকে বলিল – কালিচরণ, বৃষ্টিভেজা মৃত্তিকার মাঝে এক লুকানো মিষ্টি ঘ্রাণ আছে, একবার শুঁকে দেখ। কালিচরণ মুখ বিকৃত করিয়া তাহার বিরক্তি প্রকাশ করিল। অবলা বুঝিতে পারিল দারিদ্রতা এই মানুষটার মাঝে সকল সুকুমার বৃত্তি কাড়িয়া লইয়াছে। সাদা-কালোর মাঝে যে বিশাল এক অদেখা জগত আছে, ও তো সেই জগত কখন দেখেই নাই।

অবলা কালিচরণের হাতখানি হাতের মাঝে রাখিয়া বলিল – কালিচরণ, চলনা আজ বৃষ্টির মাঝে দৌড়ে যাই দূরে বহুদূরে। কালিচরণের অনাগ্রহ দেখিয়া অবলা তাহার হাতটি ধরিয়া টানিয়া লইল। কালিচরণ ক্ষণকাল ইতস্তত করিয়া অবলার সাথে দৌড়াইতে লাগিল। পায়ের নীচে ছলাৎ ছলাৎ জল, মাথার উপর ঝরে পড়া বৃষ্টির মাঝে কালিচরণ ভুলিয়া গেল ও কে, কোথা হইতে আসিয়াছে! কালীচরণের চেহারা হইতে দারিদ্রের চিহ্নটুকু মুছিয়া গেল। বাবরী দুলানো ঘন কেশের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল তাহার সরল সহজ মুখাবয়ব। কালিচরণ অবলাকে পিছনে ফেলিয়া দৌড়াইয়া চলিল দিগন্তের পানে। অবলা ঘনঘন শ্বাস ফেলিয়া কালিচরণের কাছে নতি স্বীকার করিয়া এক অপার সুখানন্দে তাহাকে পেছন হইতে আঁকড়াইয়া ধরিল। দু’জন বন্ধুর মতো একে অপরের গায়ে ঢলিয়া পড়িল। অদূরে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়াইয়া থাকা এক কদম্ব বৃক্ষ দেখিয়া কালীচরণ চঞ্চল বালকের মতো ছুটিয়া গেল তাহার পানে। মুহূর্তে গাছে উঠিয়া ভাঙ্গিয়া আনিল ডাল শুদ্ধ একরাশ ফুল। নিজের জন্য একখানা রাখিয়া সবগুলো অবলার হাতে সমর্পণ করিয়া হৃষ্ট চিত্তে দাড়াইয়া রহিল। কি রে তোর সংসার করিতে মন চায়? ঘরে তোর একটা বৌ থাকিলে কতোই না ভাল হইত! তুই ওর খোঁপায় গুঁজিয়া দিতি তোর হাতের ফুল। কালিচরণ অবলার কথায় আজ আর আগের মতো অপ্রতিভ হইলো না। শুধু ম্লাণমূখে বলিল – বাবু, আমি ওকে কী খাওয়াইবো…?

চলবে…

। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

 

সংবাদটি শেয়ার করুন