ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….
অবলাচরণ – ১৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলা যেন তাহার কথা শুনিয়াও শুনিল না। স্মিত হাস্যে বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতির মাঝে বৃক্ষের মতো দুহাত প্রসারিত করিয়া আকাশ পানে তাকাইয়া রহিল। শরীরের কোথা হইতে একটা কাঁপুনি তাহার সর্বাঙ্গে ছড়াইয়া পড়িল। অবলা বুঝিতে পারিল দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভিজিয়া তাহার শরীর অনেকটা তাপ হারাইয়া ফেলিয়াছে। তাহার বার বার মনে হইতে লাগিল- তাহার শীঘ্র ঘরে ফেরা উচিৎ, শরীরকে তার উত্তাপ ফিরিয়া না দিলে তাহার নাজুক শরীর আরও হয়তো ভাঙ্গিয়া পড়িবে। কিন্তু কেন যেন সে ঘরে ফেরার তাগিদ অনুভব করিল না। তাহার মনে পড়িল হুমায়ুন আহমদের কালজয়ী উপন্যাসের মোবারকের কথা। মাটি খুঁড়ে ও সুখের প্রত্যাশায় গাছ হইতে চাহিয়াছিল। হয়তো লেখক নিজেই মোবারক হইয়া বৃক্ষ-জীবনের সাথে একাত্ব হইয়া অপার্থিব অনুভূতি লাভ করিতে চাহিয়াছিলেন। এই সব ভাবিয়া আজ যে সুযোগ তাহার জীবনে আসিয়াছে – তাহাকে সে কিছুতেই হাত ছাড়া করিতে চাহিল না। কিন্তু তীব্র কাঁপুনি তাহার সেই ইচ্ছা পূরণে বাঁধ সাধিল। অবলা মনে মনে বলিল সামান্য কাঁপুনির কাছে সে কিছুতেই হার মানিবে না। হিমালয়ের হার কাঁপানো শীতলতা উপেক্ষা করিয়া নাঙ্গা শরীরে সন্ন্যাসীরা ধ্যানমগ্ন হইয়া থাকে। অনেকে ইহার মাঝে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার ধারনা পোষণ করিলেও অবলা জানে এ এক বিশেষ কৌশল। সে যোগব্যায়ম শিখিতে যাইয়া এই আপাত অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার সন্ধান পাইয়াছে। তিব্বতিয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যাকে বলে – টুম-ম- যা আসলে যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের এক বিশেষ পদ্ধতি। যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া শরীরের তাপমাত্রা সতের ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত বাড়ানো যায়। কিন্তু এর জন্য দরকার গভীর মনঃসংযোগ। আর মনঃসংযোগের জন্য প্রয়োজন বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গভীর ধ্যানে মগ্ন হওয়া। অবলা অনেক চেষ্টা করিয়া ধ্যানমগ্ন হইবার কৌশল কিছুটা হইলেও শিখিয়াছে। আজ সে সেই কৌশল অবলম্বন করিল। সে তপস্বীর মতো গভীর ধ্যানে মগ্ন হইতে চেষ্টা করিল। মনে মনে ভাবিতে লাগিল সে গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন বেলায় এক উন্মুক্ত মাঠের মাঝে এক পায়ে দাঁড়াইয়া থাকা এক তালগাছ। তাহার পায়ের নিচে তাপদগ্ধ মাটি আর মাথার উপর গনগনে সূর্যালোক। ভাবিতে ভাবিতে তাহার শরীর উষ্ণ হইয়া উঠিল। তাহার পা আস্তে আস্তে প্রোথিত হইলো মাটির গহীনে। পায়ের নখগুলো বাড়িতে বাড়িতে শিকড়ের রূপ লইয়া সাপের মতো কিলবিল করিয়া ভূগর্ভে ঢুকিয়া গেল। তৃষার্ত তাপদগ্ধ তালগাছ তাহার শিকড়কে মিনতি করিল – জল চাই, আরও জল। শিকড়েরা সেই খবর পাইয়া জল দাও জল দাও বলিতে বলিতে শুষ্ক মাটি ভেদ করিয়া জলের সন্ধানে অনেক অনেক গভীরে চলিয়া গেল। ভূগর্ভের লুকায়িত লোমহর্ষক রহস্য ডালপালা মেলিয়া অবলার সামনে উন্মুক্ত হইলো। পাথরের খাঁচে ছোট বড় অনেক জলাধার তাহার সামনে দৃশ্যমান হইলো। সে দেখিল বৃষ্টির জল কঠিন মাটিকে শিক্ত করিয়া সূক্ষ্ম ছিদ্রপথ দিয়া পরিশোধিত হইয়া সেই জলাধারে পতিত হইতে। নৈঃশব্দ্যের আবরণ ভেদ করিয়া পাথরে পাথরে ঠোকর খাইয়া তাহার কানে বাজিল সেই অপার্থিব জল পতনের শব্দ – টুপ, টাপ, টুপ টাপ টাপুস, টুপুস…

অবলা বইপুস্তকে পড়িয়াছে www (wood wide web) এর কথা। পাতালপূরীতে শিকড়ে শিকড়ে মিতালী করিয়া বৃক্ষরাজি গড়িয়া তুলিয়াছে এক বিশাল নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে সাথ দিয়াছে উদ্ভিদ, প্রাণী, প্রটোজোয়া, মনেরার পাশাপাশি বয়ে যাওয়া ফানগি রাজত্বের প্রতিনিধি – ছত্রাক। শিকড়ের অভ্যন্তরে, বহিঃগাত্রে ছত্রাকেরা বাসা বাধিয়া গড়িয়া তুলিয়াছে এক সমজোথার জগত – ছত্রাকেরা বৃক্ষকে নাইট্রোজেন সহ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক প্রদান করিবে, তার বিনিময়ে বৃক্ষ দেবে তাকে শর্করার জোগান। অবলা জানিয়াছে এই নেটওয়ার্ক দিয়েই বৃক্ষ তাহার নিকট-আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। ছায়াপ্রদায়ী বিশাল বৃক্ষ তাহার স্নেহতলে জন্ম নেওয়া লতাগুল্মকে দেয় শর্করা সহ টিকে থাকার প্রয়োজনীয় প্রাণ রাসায়নিক। কোন বৃক্ষ রোগজীবাণু বা বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হইলে সে খবর তড়িৎ পৌছিয়ে যায় এই নেটওয়ার্ক ধরে। এই মহাসড়ক ধরেই বৃক্ষ তাহার কষ্ট, দুঃখ, সুখ আনন্দের বার্তা পৌঁছাইয়া দেয় আপন জনের ঘরে ঘরে।

অবলা হতবিহবল হইয়া প্রত্যক্ষ করিল মাটির গহীনে, আড়ালে অন্তরালে ঘটিয়া যাওয়া বিশাল এক কর্মযজ্ঞকে। ভাবিয়া অবাক হইলো মানুষ প্রাচীন শিলালিপির উপর অস্পষ্ট দুর্বোধ্য আকিঝুকির মাঝে লুকানো তথ্যের পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হইলেও বৃক্ষের ভাষা আজও বুঝিতে পারে নাই। আজও এ ভাষা শুধু বৃক্ষই বুঝিতে পারে। শুধু বুঝিতে পারে তাই নয়, বাস্তবিক জগতের www এর মতো বৃক্ষের এই www এর মাঝে ব্ল্যাক অয়াল নাটের মতো কিছু বৃক্ষ সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ করিয়া তথ্য চুরি করিয়া, পরিবর্তিত করিয়া, এমন কি বিষধর রাসায়নিক ছড়াইয়া দিয়া নিরীহ বৃক্ষদের হত্যা পর্যন্ত করিয়া ফেলে ।

অবলার অগোচরে বৃষ্টির তেজ কমিয়া আসিল। ঘনকালো মেঘের আড়াল হইতে এক ফালি সূর্যালোক বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিকে রাঙাইয়া তুলিল। প্রকৃতির এই পরিবর্তন অবলাকে জাগাইয়া তুলিল। অবলা তাকাইয়া দেখিল – বৃষ্টির পরশে বৃক্ষেরা হইয়াছে আরও সবুজাভ, আরও প্রাণোচ্ছল। পথে চলিতে চলিতে অবলা কালীচরণকে বলিল – কালীচরণ, আমি তোমায় ভুল বলিয়াছি – বৃষ্টি শুধু বৃক্ষের জন্যেই ঝরে না, এই অবলার জন্যও ঝরিয়া পরে- কখনো ভেতরে, কখনো বাহিরে…

চলবে…

। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন