ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ১১ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য়

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ১১ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য়

পূর্ব  প্রকাশের পর। পর্ব- ১১

রাস্তার একদম শেষ প্রান্তে খেজুর গাছের ছায়ায় দরমার বাড়িটি হল লক্ষীমনী বাউলের৷ সঙ্গে থাকে সাধন সঙ্গী প্রেমচাঁদ বাউল৷

লক্ষীমনি মাটির দাওয়ার এক কোনে দরমা ঘেরা একটা জায়গায় রান্না করছিল৷ রান্না বলতে সেরকম কিছু না সব্জি সেদ্ধ আর ভাত৷ সঙ্গে কুমড়োর ছেঁচকি৷

রমলাকে বেড়ার ছোট গেটটা খুলে উঠোনে পা দিতে দেখেই লক্ষীমনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল৷

রমলা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছো দিদি ?

লক্ষীমনি বলল, ভালো আছি বোন৷ কতদিন বাদে তুমি আসলা আমার ঘরে৷ চল চল দুটো সুখ দুঃখের কথা কই৷

———— আজই আমি কলকাতা থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরলাম ৷ আজ তোমার বাড়ি খেয়ে দেয়ে বিকালে বাড়ি যাব৷

——— বাঃ খুব ভালো খুব ভালো৷ চল বোন ঘরে চলো৷

মাটির উনুনে মাটির হাড়িতে সব্জির সঙ্গে চাল ফুটতে লাগল৷

দরমার দরজা ঠেলে লক্ষীমনি ঘরে ঢুকল৷ প্রেমচাঁদ মাটিতে মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছিল৷ গরমে খুব কষ্ট হয়েছে৷ এখন বর্ষা এসেছে৷ শ্রাবণের আকাশ সব সময়েই কালো হয়ে থাকে৷ ভেজা মাটি, তবুও বালি দিয়ে গলে যাওয়া মাটিকে আটকে রাখা হয়েছে৷

রমলা আর লক্ষীমনি ঘরে ঢুকতেই প্রেমচাঁদ উঠে বসল৷ লক্ষীমনি বলল, দেখো কে এয়েচে?

প্রেমচাঁদ একগাল হেসে বলল, আরে দিদিমনি যে৷ কতদিন পরে এলে৷

রমলা বলল, কেমন আছো প্রেমচাঁদ দা ?

প্রেমচাঁদ বলল, দিদিমনি আছি গো৷ সদাই আনন্দে থাকি৷

লক্ষীমনি বলল, ভাতটা হয়ে গেছে৷ তুমি গিয়ে ভাতটা নামিয়ে ফেলো৷ আমি একটু আমার বোনের সঙ্গে গল্প করি৷

প্রেমচাঁদ বলল, বেশ বেশ৷

প্রেমচাঁদ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল৷

প্রেমচাঁদ বেড়িয়ে যেতেই লক্ষীমনি রমলার গা ঘেষে বসল৷ তারপর বলল, বল দিকিন বোন এখন কেমন আছিস ?

রমলা বলল, আছি দিদি৷ একটা খবর দিতে তোমার এখানে এলাম৷

—— কি খবর রে ?

——— দিদি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে৷

লক্ষীমনির মুখটা খুশীতে ঝলমল করে উঠল৷

রমলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দেখ দেকি আমার বোনটা এখন শ্বশুর বাড়ির ঘর করতে যাবে৷ কবে বিয়ে ঠিক হয়েছে রে?

রমলা বলল, ২০ শে শ্রাবণ৷ কলকাতায় ওনারা থাকেন৷ ওরা খুব বড়লোক জানো৷

কথাগুলো বলে রমলা চুপ করে গেল৷

রমলাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন লক্ষীমনি৷ তাই একটু বিষন্নতা মনের মধ্যে এলেও সেটা বুঝতে দিল না৷

মুখে হাসি নিয়ে বলল, খুব ভালো খবর রে৷

মনে মনে বলল, গ্রামের মাটির গন্ধ এখনও রমলার গায়ে লেগে আছে ৷ ও কি ওখানে মানাতে পারবে ৷ রাধামাধব ওকে ভালো রেখো৷

শ্রাবণের জলভরা মেঘ আকাশে ডুকরে উঠল৷ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল৷

বৃষ্টির দুপুরে খাওয়া সেরে মাটিতে চাটাই পেতে সবাই গোল হয়ে বসল৷ প্রেমচাঁদ একতারা হাতে সুর তুলল, লক্ষীমনি দুহাত তুলে গাইতে লাগল,

ও কালো মানিক এবার বাঁশী হাতে নাও / কতদিন পরে রাই এলো যে মোর ঘরে৷”

লক্ষীমণির সুধামাখা গলা আর প্রেমচাঁদের একতারার সুর মিলেমিশে এক প্রেমময় জগতে নিয়ে গেল৷

বিকেল হতে মেঘ ঢেকে দিল সূর্যকে৷ রমলা বলল, দিদি এবার আমি বাড়ি যাব৷ তোমরা কিন্তু বিয়ের দিন যেয়ো৷

লক্ষীমণি মাথা নাড়ল৷ পাশের বাড়ির গয়াকে ডেকে লক্ষীমনি বলল, ও গয়া তোর সাইকেল ভ্যানে দিদিমনিকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আয়৷

গয়ার ভ্যানে উঠে রমলা যখন বাড়ি পৌছল তখন মেঘের রঙ কালো৷

রমলাকে সদর দরজায় নামিয়েই গয়া ভ্যান ঘুরিয়ে রওনা দিল৷ রমলা বলে উঠল, গয়াদা ভাড়া নিয়ে যাও৷

গয়া খানিক দূর থেকে বলে উঠল, পরে নেব দিদি৷ এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছাই৷ আকাশ যেভাবে সেজে উঠেছে, এক্ষুনি নামল বলে৷

রমলা বাড়ি ঢুকতেই মায়ের একচোট বকুনি খেল৷ — হ্যা রে , তোর কি আর ঘরের দিকে মন হবে না৷ এত দিন বাদে বাড়ি এলি, সেই বাড়িতে না ঢুকে চলে গেলি লক্ষীদিদির ঘরে৷

রমলা মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি করবো বলো মা, তোমার দস্যি মেয়ে যে এরকমই ছন্নছাড়ি৷

রমলার মা বলল, নে এবার স্নান সেরে আয়৷ আজ একাদশী ঠামি তোর জন্য সাবু মেখেছে৷

বাড়ির আদরের মেয়ে তা শুনে লাফ দিয়ে উঠল৷

কাপড় নিয়ে ঢুকল স্নান ঘরে৷

রমলার মা হাসতে হাসতে বলল, পাগলী একটা৷

কিছুক্ষণ বাদে রমলা স্নান সেরে একটা সবুজ রঙের জঙলা শাড়ি পরে ঠামি বিভাবতী দেবীর ঘরে গেল৷

প্রভাবতী দেবী রমলাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ — দিদি তুমি কখন এসেছো, আমি পথ চেয়ে বসে আছি, দিদি এসে কখন ঠামি বলে জড়িয়ে ধরবে৷ এতক্ষণে তুমি এলে৷

রমলা হেসে ফেলল৷ ঠামিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ঠামি বাড়িতে ঢুকলে তো আর ছাড়া পাবো না৷ তারপর আবার বিয়ে ঠিক হয়েছে৷ দুদিন বাদে বরের বাড়ির লোক আসবে তোমরা তো আর বেড়োতেই দেবে না৷ তাই একটু লক্ষীদিদির গান শুনে এলাম৷

কথাগুলো বলে রমলা আদুরে গলায় বলে উঠল, ঠামি কতদিন তোমার গায়ের গন্ধ পাইনি৷

প্রভাবতী দেবী বলে উঠলেন ওরে আমার সোনা দিদি৷ নে ছাড় এবার তোর জন্য সাবু মেখে রেখেছি৷

বড় একটা কাঁসার বাটিতে সাবুমাখা এনে নাতনির হাতে বাটিটা দিলেন বিভাবতী দেবী৷

রমলা সাবুমাখা মুখে পুরে বলল, ঠামি কতদিন বাদে তোমার হাতের স্বাদ পেলাম গো৷

বাইরে তখন মেঘের গর্জনের সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টির উত্তাল নাচ শুরু হয়েছে৷

ঘর বাড়ি সাজ গোজ শুরু হয়েছে৷ আর কদিনের মধ্যেই রমলার হবু শ্বশুরবাড়ির লোক আসবে৷

বাড়িতে তাই তুমুল ব্যস্ততা৷ এমনিই প্রত্যেক বছর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে রমলাদের বাড়িতে সব কিছু নতুন কেনা হয় এবং একটা নয় সবই দ্বিগুণ কেনা হয়৷

এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয় নি৷ আর যেহেতু রমলার বিয়ের একটা আভাস এসেছিলই তাই রমলার মা আর কার্পণ্য করেননি৷ প্রতিবারের থেকে আরও চতুর্গুণ জিনিস কেনা হয়েছে এবার৷ দেখতে দেখতে ওদের আসার দিন এসে গেল৷ আর মাঝে মাত্র দুদিন৷ একদিন ঘরদোর যেমন সাজাবার তোড়জোড় চলেছে তেমনি চলেছে রমলারও সমানতালে রূপচর্চা৷

প্রতিদিন রাতে রমলার মাথায় ঘষে ঘষে নারকেল তেল গরম করে লাগিয়ে, চুলের গোড়া শক্ত করে ফিতে দিয়ে বেঁধে দিতেন রমলার ঠাকুমা প্রভাবতী ৷ আর রমলার মা রাতের বেলা রিঠা সিদ্ধ করে রাখতো, দুদিন বাদে বাদেই রিঠা দিয়ে চুল পরিষ্কার করা হতো৷

এতো গেল চুলের ব্যাপার ৷ আর ত্বকে প্রতিদিন দুধের সঙ্গে বেসন আর কাঁচা হলুদ বেঁটে একসঙ্গে মিশিয়ে মেখে স্নান সেরে সরষে তেলের মধ্যে কাঁঁচা হলুদ, জাফরান দিয়ে ফুটিয়ে ছেঁকে তেলটা কাঁচের শিশিতে রেখে দেওয়া হয়েছিল, স্নান সেরে ভেজা শরীরে সেটা রোজ মাখা— এই ছিল রমলার রোজের রূপচর্চা৷

তারসঙ্গে খাওয়াদাওয়া তো আছেই৷ রোজ বাড়িতে পাতা টক দই আর শশা খেতেই হবে৷ এতে নাকি ত্বক জ্বল জ্বল করে৷

এসবের আতিশয্যর মধ্যেই রমলার মন পরে থাকল লক্ষীমণির ঘরে৷ পাবে কবে একটু ফাঁক আবার যাবে লক্ষীদিদির বাড়ি৷ কিন্তু বাড়ির লোকের কড়া নিষেধ এখন কোনওমতেই বাড়ির বাইরে বেড়োনো যাবে না৷

আজ সেই শেষ রাত থেকেই রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে৷ রান্নার ঠাকুর পাঁচকড়ি দুটো মাটির উনুনে বড় লোহার কড়া চাপিয়ে রান্না শুরু করে দিয়েছে৷ সব মিলিয়ে জনা ত্রিশের রান্না৷ শুধু যে পরিবারের জন আর অতিথিরা নয়, এর মধ্যে কাজের লোকরাও আছে৷

কাজেই মশলা বাটা, কুটনো কোটা, তাদের ভাল করে ধুইয়ে পরিষ্কার করা তারপরে তো রান্না৷  ভোর রাত থেকে জোগাড় যন্তর না করলে চলবে৷

সেই জোগাড়েই মেতেছে রান্নার ঠাকুর পাঁচকড়ি আর রাধুনী মাসি মন্তা৷ এই অঞ্চলে পাঁচকড়ির মতন রান্না কেউ করতে পারে না৷ হামাল দিস্তার ঠং ঠং শব্দে চলছে গোটা মশলা পেষা আর শিল নোড়ায় চলছে আরও মিহি করে বাটা৷

কাঁচা সব্জি কাঁটছে টেপির মা৷

আকাশ ফর্সা হলেই রমলার জেঠা সদানন্দ গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যাবে৷ স্টেশনে বড় বাজার বসে৷ ওখান থেকে মাছ, মাংস,  নিয়ে আসবে৷ সঙ্গে যাবে রমলার কাকার ছেলে নীতেন৷

সদানন্দ খুব ভালো মানুষ৷ ব্যাবসাপত্তর সব কিছু দুই ভাইয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছেন৷ বাড়িতে মা কালীর মন্দির আছে৷ মা ভবতারিণী যা উনি স্বপ্নে পেয়েছেন সেই মাকেই উনি মন্দির বানিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ মায়ের সেবা করেই তার সারাটা দিন কাটে৷ সদানন্দর স্ত্রী নির্মলা বাড়ির বড় বউ, তিনিই সংসারের সর্বময় কর্ত্রী৷ তবে বাড়িতে এতটাই শৃঙ্খলতা সবাই যাই করবে সব বাড়ির বর্ষীয়ান সদস্যা রমলার ঠাকুমা প্রভাবতী দেবীর অনুমতি নিয়েই করেন৷

সদানন্দ আর নির্মলার দুই ছেলে সত্যেন আর ব্রজেন৷ ওরা গ্রাজুয়েট হবার পর কাকাদের সঙ্গে পারিবারিক ব্যাবসায় যুক্ত হয়েছে৷ রমলা ওর বাবা, মায়ের একটাই মেয়ে , আর রমলার কাকা আনন্দ আর কাকীমা অনিমা , ওনাদের একটাই ছেলে নীতেন৷ ও এখন কলেজে পড়ে৷

ভোর চারটের সময় সদানন্দ ঘুম থেকে উঠে আগে মায়ের মন্দিরে যায়৷ মাকে শয়ন থেকে তুলে সকালের ভোগ নিবেদন করে৷ তারপর অন্য কাজ৷ আজও এই কাজের অন্যথা নেই৷

মায়ের মন্দিরের কাজ সেরে সদানন্দ  তৈরী হয়ে দালানে দাড়াতেই নীতেন বড় বড় বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসে  উপস্থিত হল৷

বলল, জেঠামনি তুমি দাড়াও আমি গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বার করছি৷

কিছুক্ষণ পর অস্টিন গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বার করে স্টিয়ারিঙ ধরেই সদানন্দকে নিয়ে চলল স্টেশনের দিকে৷

বর্ধমান স্টেশনের থেকে যে রাস্তাটা সদর রাস্তার দিকে গেছে সেই রাস্তার ধারে একটা বড় মাঠে বাজার বসেছে৷ নীতেন গাড়িটা রাস্তার ধারে দাড় করালো৷ তারপর বাজারের জন্য চটের ব্যাগদুটো নিয়ে নামল৷ সদানন্দও নামলেন৷

সদানন্দকে বাজারে ঢুকতে দেখে সবাই হৈ হৈ করে উঠল৷ — বড়বাবু এখানে আসেন, বড়বাবু এখানে আসেন৷

সে এক মহা কলরব বড়বাবু এসেছেন বাজারে৷

সদানন্দও সবার খবর নিতে লাগলেন৷ দর দামের কোনও বালাই নেই৷

ভেটকি, বড় রুই, চিতল, গলদা, ইলিশ, আর তার সঙ্গে দুটো গোটা কচি পাঁঠা নিয়ে বাজার সারা হল৷ সদানন্দ সবাইকে বলতে লাগলেন, বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে৷ আজকে ছেলের বাড়ির লোকজন আসবে৷

বাজার নিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকলেন সদানন্দ তখন নটা বেজে গেছে৷ সদানন্দ গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে গেলেন৷ এখন সকালের প্রাতঃরাশ সেরে , আবার স্নান সেরে মায়ের মন্দিরে যাবেন, দুপুরে মায়ের ভোগের আয়োজন হচ্ছে, সেখানে থেকে মাকে ভোগ নিবেদন করে , তারপর ওনার অন্য কাজকর্ম শুরু হবে৷ অন্য কাজ বলতে বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র পড়া, যখন যা মনে আসবে তা লিখে রাখা৷ মা ভবতারিণীকে নিয়ে অনেক গানও লিখেছেন উনি, সেগুলো আবার মায়ের মন্দিরের নিত্য পূজারী নির্মল চক্রবর্তীর মেয়ে তরুলতা সুরে বেঁধে হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রায়ই গায়, সদানন্দ তখন চোখ বুজে গানগুলো শোনেন, দুচোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পরে৷

নীতেন থলে ভরা মাছ নিয়ে ঢুকল, রান্নার চাতালে৷ আর পাঁঠা দুটোকে নিয়ে পেছন পেছন এল বাড়ির আর এক কাজের লোক নিমাই৷

ততক্ষণে পাঁচকড়ির নিরামিষ রান্না হয়ে গেছে৷ নিরামিষ রান্নার মধ্যে হয়েছে সব্জি দিয়ে সোনা মুগ ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, মোচার ঘন্ট, ছানার ডালনা, আমের চাটনি৷

নিরামিষ রান্নাগুলোকে পাঁচকড়ি আগেই সরিয়ে রেখেছে আলাদা করে, যাতে আমিষ রান্নার সঙ্গে ছোঁয়া না লাগে৷ আর পাড়ার হালুইকরকে আগেই বলা ছিল, সে বলেছে বারোটার মধ্যে দই, মিষ্টি সব দিয়ে যাবে৷

আমিষ বাজার এসে যাওয়ায় ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল৷ নীতেন পাঁচকড়িকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে গেল৷ আজকে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিতে হবে৷ বাড়িতে হবু কুটুম আসবে৷ ভেতর বাড়িতে তখন তুমুল ব্যস্ততা ৷ সকালের জল খাবারের প্রস্তুতি চলছে৷

সকালের জলখাবারের মধ্যে রাখা হয়েছে লুচি, আলুর দম, ঘুগনী আর পায়েস৷ ঘড়ির কাঁটা বেলা এগারোটা গড়াতে চলল, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন চলে আসবে৷

রমলা আজ ঘুম থেকে উঠেই সোজা স্নানে চলে গেল৷ স্নান সেরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে গেল প্রণাম সারতে৷ সদানন্দ তখন কুশের আসনে বসে চোখ বুজে রয়েছেন৷

নির্মল পূজারী আর তার মেয়ে তরুলতা মায়ের দুপুরের ভোগের রান্না সেরে তা পাথরের থালায় সাজিয়ে মাকে সেবা নিবেদনের জোগাড়ে ব্যস্ত৷ দুপুর বারোটার মধ্যেই ভোগ নিবেদন করতে হবে৷

রমলা মন্দিরে ঢুকে মা ভবতারিণীর মূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে উঠতেই, সদানন্দ ডাকলেন, মা এসেছিস৷ মাকে প্রণাম করেছিস৷

রমলা বলল, হ্যা জেঠামনি৷

সদানন্দ রমলাকে তার পাশে বসতে বললেন৷

রমলা পাশে বসলে সদানন্দ রমলার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, মা জন্ম থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি৷ এখন বড় হয়েছো৷ নিজের সংসার করতে যাচ্ছো৷ সং  সাজাই সার সেটাই  সংসার৷ আমরা সবাই নাটকের কুশীলব৷ আসল সুতো ওই বেটির হাতে৷ আমরা সবাই মালি , মালকিন সে৷ কাজেই যে কাজই করো না কেন ওই বেটিকে স্মরণ কোরো৷ দেখবে মা ভবতারিণী তোমাকে ঠিক রক্ষা করবেন৷

রমলা মন দিয়ে চুপ করে তার জেঠামনির কথাগুলো শুনল৷ ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল দুগালে৷ সদানন্দ পরম স্নেহে রমলাকে বুকে টেনে নিলেন৷ রমলা তার জেঠামনির বুকের মধ্যে ফুপিয়ে উঠল৷  রমলা আজকে পরেছে একটা সবুজ আর লাল রঙের জামদানি৷ কপালে ছোট একটা লাল রঙের টিপ৷ কানে ঝুমকো ,গলায় নেকলেশ আর দুহাতে দুটো কঙ্কন৷ দু হাতের অনামিকায় একটা আঙটি৷ চুলটা খেজুর বিনুনী করে দিয়েছে রমলার কাকীমা৷ একদম মা দুগ্গা লাগছে৷ বাড়িতে হৈ হৈ পরে গেছে৷ রমলার হবু শ্বশুরবাড়ির লোক চলে এসেছে৷ তাদের মোটর গাড়ি রমলাদের উঠোনে থামতেই রমলার বাবা আর কাকা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন৷ ওনাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে সোজা দোতলার বড় বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল৷ এরকম একটা সাতমহলা বাড়ি দেখে রমলার হবু  শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সত্যিই অভিভূত৷

প্রথমেই পিতলের মিনে করা গ্লাসে ঠান্ডা লেবুর সরবত দেওয়া হলো৷ এই বাড়ির সব থেকে পুরনো কাজের লোক হরিদাই সবাইকে শরবত দিল৷ তারপর বড় বড় পেতলের রেকাবিতে ভর্তি জলখাবার আনা হল৷ রমলার শ্বশুরের তো সব কিছু দেখে চড়কগাছ৷ ওনারা কলকাতার লোক এত খেতেও পারেন না৷

তবু রমলার বাবার অনুরোধে সব খেতে হল৷ এর মধ্যেই পরিবারের একে একে সবাইকে ডেকে আলাপ পরিচয় করানো হল৷

সদানন্দ খুবই কম কথা বলেন৷ তবু এটুকু সময়ের মধ্যে সবাইকে একটু বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন৷ হাজার হোক বাড়ির একমাত্র মেয়ে যেন সুখী হয়৷

সকালের জলখাবার শেষ করার পর ওনাদের তিনতলার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল৷ পরপর তিনটি পালঙ্ক সাজানো ঘর৷ বারান্দার একদম শেষ প্রান্তে স্নানঘর৷ রমলার বাবা, কাকা এবং মা ওনাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, আপনারা একটু বিশ্রাম নিন৷ আমরা এখন আসছি৷

ঘন্টাখানের মধ্যেই ওরা  বাথরুমে গিয়ে স্নানের পর্ব সেরে নিল৷ স্নানঘরটাও কম বড় নয়৷ প্রায় দুটো বড় ঘরের সমান৷ একটা বিশাল শ্বেত পাথরের বাথটব৷ পাথরের মেঝে , দেওয়ালটা পুরোটাই সাদা পাথরে ঢাকা৷ স্নানঘরে সুদৃশ্য পেতলের মিনে করা কল৷ কুঁয়োর ভেতর থেকে পাম্পের জল গিয়ে পৌছয় ছাদের সিমেন্টের জলের আধারে৷ সেখান থেকেই গোটা বাড়িতে জল সরবরাহ৷ সত্যি কথা বলতে কি ওরা ভেবেছিলেন রমলারা বর্ধমানের বনেদী বাড়ি ঠিকই , কিন্তু বনেদীয়ানার সঙ্গে আধুনিকতারও একটা ছোঁয়া আছে সেটা ওদের মনের মধ্যেই আসেনি৷

কিছুক্ষণ বাদেই  নৃপেন্দ্রবাবু এসে উপস্থিত হল৷  — চলুন আমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবেন ৷ শ্রাবন মাস৷ রোদের তেজ কম৷ আকাশ কখনও মেঘলা আবার কখও সূর্যি মেঘের আড়ালে হাসে৷ বাতাসে একটা ঠান্ডা ভাব৷ বেশ ভালই লাগে সবার৷ কখন যে আবার বৃষ্টির ধারা নামে তার কোনও ঠিক নেই৷

প্রাণতোষের মনটা একটু ব্যাকুল হয়ে আছে৷ কতক্ষণ হয়ে গেল রমলাকে দেখেনি৷ রথীন্দ্রবাবু  ওদের সঙ্গে এক গাড়িতে এলেও পথের মাঝখানে এক জায়গায় নেমে পরেছেন, ওখানে ওনার এক পিসি থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করে তারপর শ্যালীকার বাড়ি ফিরবেন৷

তাই রমলার হবুশ্বশুরও একটু উতলা হয়ে আছেন কখন তার বন্ধুপ্রবর আসবেন৷ উনি আসলে পরে রমলার শ্বশুর একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই রথীন্দ্রবাবু  এসে উপস্থিত হলেন ৷ উনি  ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল৷ রমলার কাকীমা বলে উঠল— আমাদের ঘটক মশাই এসে গেছেন৷ তা ঘটক মশাই বিয়ের দিন আপনাকে কি দিয়ে ঘটক বিদায় করতে হবে৷

রমলার কাকীমার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল৷

প্রভা রমলাকে ধরে নিয়ে এল৷ অপূর্ব লাগছে রমলাকে৷ প্রাণতোষ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রমলার দিকে৷

নৃপেন্দ্রবাবু  বললেন, চলুন বাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি৷

রমলার মাসি রমলার মেসোর কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেনো ফিসফিস করে বলল৷

রথীন্দ্রবাবু  প্রাণতোষের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, চল আমরা বরং ঘুরে দেখে আসি৷ প্রাণতোষ এখানে থাক৷ আশুতোষবাবু বিচক্ষণ৷ উনি বুঝতে পেরে বললেন, তাই চলো৷

সবাই চলে গেলে পর, প্রভা  প্রাণতোষের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা একটু গল্প করো৷ আমি রান্নার দিকটায় একটু যাই৷ দেখি দুপুরে খাবার আয়োজন কতটা হল৷

প্রভা চলে গেল৷ প্রাণতোষ রমলাকে একা পেয়ে জড়তা কাটিয়ে বলে উঠল, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে৷

রমলা হেসে বলে উঠল, তাই বুঝি?

প্রাণতোষ বলল, ওরা সবাই ঘুরতে গেল৷ আমরাও যদি একটু ঘুরে আসতাম৷

রমলা বলল, ইচ্ছে করছে যেতে৷ তাহলে চলুন৷ এই বাড়িতে আমার সবথেকে প্রিয় জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাই৷

—— তাই বুঝি৷ তোমার প্রিয় জায়গা৷ তাহলে তো যেতেই হয়৷  দুজনেই হেসে ফেলল৷

আকাশে কালো মেঘগুলো আস্তে আস্তে কুন্ডলী পাকিয়ে এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে৷ সঙ্গে একটা ঝোড়ো হাওয়া৷ রমলা তার আচল উড়িয়ে নিয়ে চলেছে বাড়ির একদম পেছনের দিকে , সঙ্গে প্রাণতোষ৷

এদিকে একটা ছোট্ট ডোবা৷ তার পাশেই দুকামরার একটা বাড়ি৷ ঘরদুটোই তালাবন্ধ৷ তালাগুলো যে বহুদিন খোলা হয় না সে বোঝা যায়  তালার জঙ ধরা মরচে দেখে৷ অশথ্থ গাছের ডাল পালা বাড়িটাকে পুরো গ্রাস করেছে৷

মাঝে মাঝে লোক লাগিয়ে ডোবার জল পরিষ্কার করানো হয়৷

ডোবার ধারে লাল শান বাঁধানো চাতালে একটা বেদী করা৷ রমলা গিয়ে ওই বেদীতে বসল৷ প্রাণতোষও এসে পাশে বসল৷

প্রাণতোষ জিজ্ঞাসা করল, তোমার এই জায়গা এত পছন্দ কেন ?

— নির্জনতা যে আমার খুব ভালো লাগে৷

— এই বাড়িটা তোমরা ব্যবহার করো না ?

রমলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বাড়ির এদিকটায় কেউ আসে না৷ ওই বাড়িতে থাকতেন আমার বাবার বাল্য বিধবা বোন৷ তিনি মারা যাবার পর কেউ এদিকে আসে না৷

রমলা , রমলা ডাকতে ডাকতে রমলার ছোট কাকা আর কাকিমা ছুটে এল।

— এখানে এসেছিস কেন ? গায়ে হলুদ পরে গেছে, বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে৷ এই জায়গায় কেউ আসে হবু জামাইকে নিয়ে৷ গায়ে হাওয়া বাতাস লাগলে কি হবে?

রমলার কাকা প্রাণতোষকে বলল, চল জামাই চলো৷

রমলার কথা আর শেষ হল না৷ ওরা সবাই মিলে মূল বাড়ির দিকে হাটতে থাকল৷

বাড়ির বড় বারান্দায় ওরা যখন পৌছল দেখল সবার মুখই উদ্বিগ্ন৷

রমলার মা মুখ গম্ভীর করে ঘরের ভেতর চলে গেল৷

রথীন্দ্রবাবু   পরিবেশ হাল্কা করার জন্য বলে উঠলেন — চলো চলো আমরা সবাই ভেতরের ঘরে গিয়ে একটু গান, বাজনা করি৷

সবাই তখন বলে উঠল — বেশ বেশ খুব ভালো হয়৷

তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে।

 

 

চলবে…

কৃষ্ণা গুহ রয়- উপন্যাসিক, কবি। পশ্চিমবঙ্গ


অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে হলে

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -১ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -২ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৩ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৪ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৫ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৬ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৭ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য়

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৮ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৯ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ১০ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

 

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন