ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ১৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

… অবশেষে জ্বর সর্দি, কাশি অবলাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল। কিন্তু যাইবার আগে ওরা অবলাকে রিমান্ডে নেওয়া আসামির মতো হাত পা ভাঙ্গিয়া শয্যাগত করিল। অবলা বুঝিতে পারিল তাহার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করিতে যাইয়া শরীরের অনেকটা শক্তি ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছে। অসুখ বিসুখ লইয়া অবলা চিরকাল মজা করিয়া আসিয়াছে। তাহার পিঠাপিঠি ছোট বোনটা ছিল যেমন নাজুক, তেমনি সংবেদনশীল। সামান্য আঘাতে চিৎকার করিয়া মাথায় তুলিত। সামান্য জ্বর-জারিতে মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর মতো প্রলাপ বকিত। অবলা সুযোগ পাইলেই সেই প্রলাপের সংলাপগুলো পুনঃপ্রচার করিয়া বোনটাকে তিক্ত-বিরক্ত করিয়া মারিত। আজ অবলা সামান্য উঠবস করিতে যাইয়া তাহার বোনটার মতো কাতরাইতে লাগিল। অবলা নিজের কানে সেই অরুচিকর শব্দ শুনিয়া বুঝিতে পারিল – তাহার বয়স হইয়াছে।

এদিকে কালীচরণের কাজ অনেকগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। অবলাচরণের দুর্বল ইমিউনিটীকে চাঙ্গা করিতে সে বন-জংগল হইতে গাছের ফল-মূল, ছাল, পাতা দিয়া জুরী বুটি বানাইয়া অবলাকে অবাধ্য বালকের মতো চাপিয়া ধরিয়া সকাল বিকালে খাওয়াইতে লাগিল। অবলার তিক্ত মুখটা একটু মিষ্টি খাইবার জন্য আঁকুপাঁকু করিতে লাগিল। কিন্তু কালীচরণের চোখ ফাঁকি দিয়া তাহা সম্ভব হইল না। কালীচরণ পড়ালেখা করেনি কিন্তু প্রকৃতির কাছ হইতে সে নিগুঢ় জ্ঞান অর্জন করিয়াছে। প্রথমে প্রথমে অবলার মনে সংশয় থাকিলেও এখন সে অনেক কিছুই তাহার উপর ছাড়িয়া দিয়াছে। অবলা মনে মনে ভাবে এই কালীচরণ না থাকিলে তাহার কী হইত ! হয়তো তাহার কষ্টের জীবনের সাথে যুক্ত হইত আরও কিছু  কষ্ট। এ সংসারে যাহার কেহ নাই, সেও বাঁচিয়া থাকে, কিন্তু কেমন করিয়া বাঁচিয়া থাকে – তাহা শুধু সেই জানে। কালীচরণ থাকাতে তাকে সেই কষ্টের তীব্র দহন দগ্ধ করিতে পারে নাই। কালীচরণ কখনো নিজের সন্তানের মতো সেবা করিয়া, কখনো তাহার অভিভাবকের মতো শাসন করিয়া অবলার মনোজগতের এতটাই দখল করিয়া লইয়াছে যে অবলা যখন নৈরাশ্যের সাগরে নিমজ্জিত হয়, তখন সে স্পষ্ট দেখিতে পায় কুলে কালীচরণ তাহার জন্য দাঁড়াইয়া আছে। বিচিত্র এই জগত ! কোথাকার কোন কালীচরণ – আজ আত্মীয়র চেয়ে অধিক আত্মীয় হইয়া উঠিয়াছে !

অপরাহ্ণের আকাশটা আজ কেন যেন বড় বিষণ্ণ ! কালো মেঘের ফাকে  সিঁদুররাঙা সূর্য অস্তাচলের আয়োজন করিতেছে। অবলা তাহার জানালা দিয়া সেই বিষণ্ণ আকাশের পানে তাকাইয়া রহিল। আজ  অবলার মনটা ঐ আকাশের মতোই কালো মেঘে ঢাকা। একটা চাপা ক্রন্দন হূ হূ করিয়া ছুটিয়া আসিল। অবলা বাধা দিল না। পাছে কালীচরণ দেখিয়া ফেলে, তাই সে সন্তর্পণে চোখের জল মুছিয়া ফেলিল। একটা হাল্কা বাতাস বহিয়া গেল। পুকুর পারের  দাঁড়াইয়া থাকা সুপরীগাছ, নারিকেল গাছগুলো মাথা দুলাইয়া দুলাইয়া অবলার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। সারি সারি সুপরী গাছের পাতার আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল কিছু  ভগ্নদেহ খেজুর-গাছ। অবলার দুর্বল শরীর তাহার মনটাকেও দুর্বল করিয়া দিয়াছে। আজ কেন যেন গলায় ছুরি চালানো খেজুর গাছগুলোকে দেখিয়া নিজকে বড় অপরাধী মনে হইল। প্রকৃতি মানুষকে পরনির্ভরশীল করিয়া তাহার সৃষ্টির মাঝে ছাড়িয়া দিয়াছে।  ক্ষুন্নীবৃত্তি মিটাইতে মানুষকে নিষ্ঠুর হইতে হয়। কিন্তু তাই বলিয়া প্রকৃতির  অন্য  সৃষ্টির প্রতি অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতা দেখানোর অধিকার তাহাকে কেহ দেয় নাই। আজ হইতে  শত বছর আগে যখন পৃথিবীর কেহ বিশ্বাস করিত না বৃক্ষের প্রাণ আছে,  তখন এক বাঙালি সন্তান জগদীশ বসু  রয়্যাল সোসায়িটির অসংখ্য সভ্য মানুষের সামনে প্রমাণ করিয়া দিয়েছিলেন – বৃক্ষেরও আমাদেরই মতো প্রাণ আছে, তারা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন। ওদেরকে আঘাত করিলে তাহারাও কষ্ট পায়। আস্তে আস্তে মানুষের সনাতন ধারনা বদলাইয়া গেলেও বৃক্ষের প্রতি নিষ্ঠুরতা লইয়া কাহারও তেমন মাথা ব্যথা নাই। দুই একজন যে নাই তাহা নয় –  বলাইয়ের মতো অর্বাচীন হয়তো  কেহ আছে। কিন্তু তাহাদের   ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করিয়া এই সমাজ তাহার প্রাণপ্রিয় শিমূল গাছকে উপড়াইয়া ফেলে।  আমরা অত্যন্ত অনাদরে কৌতুকরসে গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া ফেলি, গাছে পেরেক পুঁতিয়া সাইনবোর্ড, বিল বোর্ড ঝুলাইয়া দেই। কক্ষনো ভাবিয়া দেখিনা ইহাতে গাছের কষ্ট হয়, ক্ষত স্থানে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাধে, পচন ধরে। আর কালীচরণ তাহারই সন্মতি লইয়া কত কাল হইতে খেজুর রস সংগ্রহ করিতে যাইয়া ওদের গলায় ধারাল কাঁচী দিয়া কি নির্দয় ভাবেই না কাটিয়াছে !  অবলা শুনিয়াছে – উন্নত বিশ্বে ম্যাপল সিরাপ সংগ্রহ করিতে গাছের গায়ে  ছোট্ট একটা ছিদ্র করিয়া একটা পাইপ লাগাইয়া দিলেই যথেষ্ট। পাইপের আরেক অংশ একটা সুরক্ষিত পাত্রের সাথে সংযোগ করিয়া বাহিরের ধুলা বালি, পোকা, মাকড়, অণুজীব পরজীবের হাত হইতে অনেকাংশে মুক্ত হইয়া বিশুদ্ধ রস সংগ্রহের ধারনা কেন খেজুর রসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না – তাহা অবলাকে ভাবাইয়া তুলিল। অবলার মনে পড়িল যশোরের ওয়াহীদ সর্দারের কথা, গাছের গায়ে পেরেক ফুটানোর কষ্ট সে নিজের মর্মে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনার  বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাস্তার দু’পাশের বৃক্ষ হইতে ব্যানার , পেরেক অপসারণ করিয়া বেড়াইত। প্রথম প্রথম তাহার আন্দোলনে সে  ছিল সম্পূর্ণ একাকী। ধীরে ধীরে সে আন্দোলন বিস্তৃত হইয়াছিল গ্রাম হইতে শহরে। অবলা কি পারে না এমনি এক আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে?

অবলা বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। চিৎকার করিয়া কালীচরণকে ডাকিতে লাগিল। কালীচরন, আমার জামাটা লইয়া আয়, হাতে সময় বড়  কম, আমাকে এখনি বাহির হইতে হইবে…

চলবে….

।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


এসএস/সিএ

 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১7 ।। সুশীল কুমার পোদ্দার


 

সংবাদটি শেয়ার করুন