ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

অবলাচরণ ১৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

কালীচরণ অবলার ডাক শুনিয়া দৌড়াইয়া আসিল। অবলাচরণের চরিত্রের বাতিকগ্রস্থতার সাথে সে অত্যন্ত পরিচিত। তাই সে তাহার জামাটা লইয়া ঠায় দাঁড়াইয়া লইল। অবলার মাঝে বাতিকগ্রস্থতা দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে। তাহাকে বাঁধা দেবার কেহ নাই। হয়তো একাকীত্ব তাহার এই বাতিকগ্রস্থতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। কালীচরণ কক্ষনো তাহাদের সম্পর্কের সীমারেখা অতিক্রম করিতে চায় নাই। কিন্তু তাহাকে যে কঠিন হইতে হইবে – এই কথা ভাবিয়া সে বিরক্ত ভরে বলিয়া উঠিল – বাবু, তোমার শরীর এখন ভাল হয়নি, তোমার আজ বাইরে যাওয়া হইবে না। বিছানা ছাড়িয়া আজ মোটেই উঠিবে না। এইতো সেদিন তুমি বৃদ্ধাশ্রম করিবে বলিয়া কতকিছুই না পরিকল্পনা করিলে ! বাগানের কোথায় কোন গাছ কাটিতে হইবে, কোথায় ঘর তুলিবে, কোথায় বৃদ্ধেরা  ঘুরিয়া বেড়াইবে, কোথায় খেলিবে কতো কিছু…। আজ আবার গাছের দুঃখ-কষ্ট লইয়া খেপিয়া গিয়াছ? আসলে কি জান – অলস মস্তিষ্ক, …

অবলা কালীচরণের স্পর্ধা দেখিয়া কঠিন স্বরে তাহাকে থামাইয়া দিল । কালীচরণ তোকে ভালবাসি বলে  ভাবিস না – আমি  নিষ্ঠুর হইতে জানি না। এই বয়সে আমার নাতী নাতনীদের সাথে সুখময় সময় ব্যয় করিবার কথা,  আমার সন্তান থকিতেও আমি একা, কেন জানিস? আমার ব্যক্তিত্ব, আমার স্বাধীনতা, আর আমার অভিমান। জানিস সেই ছোটবেলাতে যখন বাবার শাসন আমার ইচ্ছেগুলোকে গলা চাপিয়া ধরিত, তখন আমি  কি বলতাম জানিস? আমি আমার ইচ্ছাকে  বলতাম – ইচ্ছা, একদিন তোমায় স্বাধীন করিয়া দেব। তুমি মেঘের মতো ভাসিয়া যাইবে,  আর তোমাতে আমি ঝুলিয়া পড়িব। আমি সেদিন আমার ইচ্ছাকে অনাদরে মরিতে দেয়নি । আজও দিব না। তর কাছে আমার  ইচ্ছাগুলো শয়তানের উস্কানি। তোর মতো এ কথা আমাকে অনেকেই বলে। আমি অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছি-  আমার  ইচ্ছার মাঝে কোন অসৎ উদ্দেশ্য  নাই।

কালীচরণের বুকটা কষ্টে টনটন করিয়া উঠিল। হাতজোড় করিয়া মিনতি করিল – বাবু, আমি তো তোমার মতো পড়ালেখা করিতে পারি নাই, তোমার ভাল চাই বলিয়া তোমাকে থামাইতে চেষ্টা করি। যেখানে যাহা বলিবার নয় – তাহাই বলিয়া ফেলি। ভগবান আমাকে অনেক কিছুই দেয়নি। তাইতো ভাল করিয়া কথাও বলিতে পারিনা।

ঠিক আছে, তুই এখন আমার সামনে থেকে যা, আমায় একা থাকিতে দে । অবলার কথায় কালীচরণ মন খারাপ করিয়া প্রস্থান করিল

অবলা বুঝিতে পারিল – তার শরীর এখনও দুর্বল।  তাই বিশ্রাম নেওয়া দরকার। বিশ্রাম লইতে যাইয়া চোখে পড়িল টেবিলের উপর জমানো অনেকগুলো চিঠি। সেই চিঠির স্তূপ হইতে তাহার ছেলে মহিমের হাতের লেখা  এক খানা লেফাফা তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিল। অবলা সে চিঠি দেখিয়াও দেখিল না। তার অভিমান আরও বেশী তীব্র হইল। সে তাহার কৃতকর্মকে কাঠগড়ায়  দাড় করিয়া মনকে প্রশ্ন করিল – আমি না হয় অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছি, আমি হয়তো রাগ করিয়া  সন্তানের মুখ দেখিব না বলিয়া  ওদের বাড়ী আসতে বারণ করিয়া দিয়াছি। তাই বলিয়া  ওরা আমায় ভুলিয়া যাইবে, আমি অসুস্থ হইয়া পড়িয়া আছি, অথচ একটিবার খোঁজ লইবে না ! অভিমানগুলো খুচাইয়া খুচাইয়া তাহার মনকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিল। অবলা উদাস হইয়া বিছানায় বসিয়া রহিল।

আস্তে আস্তে গোধূলি কাটিয়া গিয়া রাত্রির আধার নামিয়া আসিল।  অবলা আর পারিল না। ছেলের চিঠিখানা হাতে লইয়া বুকে চাপিয়া ধরিল। কতদিন হয় ওকে দেখেনি। কতদিন হয় তাহার আদরের নাতনীকে আদর করা  হয়নি।  সেই যে ছেলের ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে ! ইতিমধ্যে দেখতে দেখতে আটটা বছর চলিয়া গিয়াছে। ছেলে তাহার চাকুরী লইয়া সপরিবারে বিদেশে  চলিয়া গিয়াছে। এয়ারপোর্টে দূর হইতে সে ছেলের অগোচরে তাহাকে বিদায় দিয়াছে। ছেলে ফিরিয়া আসিয়াছে তাহাও  সে লোকমুখে শুনিয়াছে, কিন্তু কারোকে বুঝিতে দেয়নি। তাহার বুকের ভেতর এক চাপা কান্না গুমরাইয়া মরিয়াছে। সে যে মনে মনে এমনি একখানা চিঠির প্রত্যাশা করিয়াছিল। প্রত্যাশা আর বাঁধ  মানিল না। সে লেফাফা খুলিয়া ফেলিয়া চিঠি খানা পড়িতে লাগিল। বাবা, আমরা বিদেশ হইতে একেবারে চলিয়া আসিয়াছি। তোমাকে দেখার জন্য আমাদের মনঃপ্রাণ ছুটিয়া গিয়াছে। তোমার অসুস্থতার কথা শুনিয়া মনে হইতেছে – এখনি ছুটিয়া  যাই। কিন্তু, বাবা, যদি প্রত্যাখ্যাত হই, সেই ভয় আমায় পাইয়া বসিয়াছে। বাবা, আমার অপরাধবোধ আমাকে নিত্য  কুঁড়িয়ে কুড়িয়ে খায়। মাঝে মাঝে মনে হয়  আমাদের পাপের কারণেই বোধহয় আমাদের সন্তান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হইয়াছে। বাবা, তুমি একবার অনুমতি দিলেই তোমার কাছে চলিয়া আসিব।

অবলার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। কখন যে কালীচরণ তাহার পেছনে খাবার লইয়া দাঁড়াইয়া আছে তাহা তাহার চোখে পড়িল না। বাহিরের শক্ত খোলসের মাঝে  এক স্নেহপ্রবণ পিতাকে দেখিতে পাইয়া কালীচরণ অশ্রুসিক্ত হইয়া নীরবে প্রস্থান করিল।

রাত্রির খাবার সময় অতিক্রান্ত হইল। কালীচরণ দরজায় আঘাত করিয়া খাবার হাতে দাঁড়াইয়া রইলো। অবলা চিঠিটা মুহূর্তে বালিশের নিচে লুকাইয়া ফেলিয়া মুখে যথাসম্ভব কাঠিন্য আনিয়া কালীচরণকে ঘরে ডাকিয়া লইল। কালীচরণ কোথা হইতে শুরু করিবে বুঝিতে পারিল না। তাহার অপরাধী মনের মাঝে যে ঝড় বহিতেছে  তাহার প্রতিচ্ছায়া তাহার চোখে মুখে। তবুও  যেন কিছুই হয়নি এমনি করিয়া প্রতিদিনের মতো তাহাকে খাইতে দিয়া সংসারের অতি তুচ্ছ ব্যাপার লইয়া কথার বুনুনি গাঁথিতে বসিল। অবলা তাহার মুখের পানে তাকাইয়া মুখে ঈষৎ বিরক্তি লইয়া বলিল – তুই আজও সেই রোগীর পথ্য আনিয়াছিস  ?  বাবু, পায়ে পড়ি, আজকের মতো খাইয়া লও। কাল সকালেই তোমাকে ছোট মাছের  জিরে বাটা ঝোল দিয়া ভাত দিব, সাথে গন্ধ মাদনের বড়া। তোমার মুখে শীঘ্র স্বাদ ফিরিয়া আসিবে। অবলা কালীচরণের কথা শুনিয়া হাসিয়া ফেলিল। নীরবে খাইতে খাইতে কালীচরণকে প্রশ্ন করিল – কালীচরণ, তুই আমার অগোচরে ঘরের কথা বাহির করিস! তা কবে থেকে এ কাজ করিয়া যাইতেছিস? কালীচরণ ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া   লইল। তাহার এ মৌনতা বেশীক্ষণ স্থায়ী হইল না।  সে মাথা নিচু করিয়া  সে কথা স্বীকার করিয়া লইল। সাথে এও স্বীকার করিল – তাহার সাথে মহিমের আছে নিত্য যোগাযোগ।

অবলা কালীচরণের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাইয়া রইলো। সে চোখে নাই কোন ক্রোধ, নাই কোন অভিযোগ। কালীচরণ অভয় পাইয়া অবলার পায়ের কাছে বসিয়া পড়িল। বাবু, তুমি কি মহিমকে ক্ষমা করিতে পার না? তুমি কষ্ট পাও, তুমি নীরবে কাঁদ। শুধু উপরে উপরে তুমি কঠিন। অবলা ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া হাই তুলিয়া বলিল – তুই খেয়ে নে। আমার যে বড্ড ঘুম পাইয়াছে…

চলবে….

।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


এসএস/সিএ

 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১০ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ১7 ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার


 

সংবাদটি শেয়ার করুন